Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অশ্রুঝরা আগস্ট

স্নেহমাখা এক সন্ধ্যার অবিস্মরণীয় সান্নিধ্যের স্মৃতি

Icon

মাকিদ হায়দার

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্নেহমাখা এক সন্ধ্যার অবিস্মরণীয় সান্নিধ্যের স্মৃতি

লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছিল জগন্নাথ কলেজে। আমরা ভাইবোন, মাসহ থাকতাম মালিবাগের একটা ভাড়া বাড়িতে। কলেজে যাওয়া-আসার জন্য পিতাকে বললাম, ‘আমাকে একটি সাইকেল কিনে দিতে হবে।’ তিনি আমার হাতে ২০০ টাকা দিয়ে বললেন, ‘তুই নবাবপুর থেকে তোর পছন্দমতো একটি সাইকেল কিনে নিস।’ সাইকেল কিনলাম ১৮০ টাকায়, এক বিহারির দোকান থেকে এশিয়া বাইক।

আমাদের কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিউদ্দিন আহমদ। রাজু ভাই একদিন ছাত্রলীগের কয়েকজন ছেলেকে বললেন, ‘তোরা মাঝে মাঝে ইকবাল হলের ক্যান্টিনে যাবি, ওখানে ছাত্রলীগের অনেক নেতা বসেন;’ সেই মুহূর্তে তিনি বললেন, ‘শেখ শহীদুল ইসলাম ভাইকে গিয়ে বলিস আমার কথা।’ রাজু ভাইয়ের কথানুসারে সপ্তাহে দুই-তিন দিন ইকবাল হলের ক্যান্টিনে যেতাম, কলেজ ছুটির এক বিকালে শেখ শহীদুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি জানতে চাইলেন, ‘লেখাপড়া কোথায় করো’, বললাম, ‘জগন্নাথ কলেজে। রাজু ভাই আপনার কথা বলেছে আমাদের।’

মাসখানেকের ভেতরেই শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে ছোট ভাই বড় ভাইয়ের সম্পর্কের সুবাদে তিনি একদিন বললেন, ‘তোমার সাইকেল ওই গাছের কাছে রেখে তালা লাগিয়ে দাও।’ ক্যান্টিনের একজন বয়কে বললেন, ‘সাইকেলটা দেখে রেখো। আমরা আসছি ঘণ্টাখানেক পরে।’ তিনি একটি রিকশাওয়ালাকে বললেন, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডে চলো, রিকশাচালক জানালেন, ‘আমি ঢাকায় এসেছি মাত্র দিন কয়েক আগে, আমি কিছুই চিনিনে।’

শহীদ ভাই বললেন, ‘ঠিক আছে চলো, আমিই দেখিয়ে নিয়ে যাব।’ রিকশায় চেপে তিনি জানতে চাইলেন, ‘বাড়ি কোথায়?’ জানালাম পাবনায়, অনেক কথার পর অগ্রজ জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার, আমার আপন ভাই বললাম। ইতোমধ্যে হাজার কথায় মাঝদিয়ে নিউমার্কেট ছাড়িয়ে কলাবাগান পেরিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের মাথায় এসে রিকশাচালককে শহীদ ভাই বললেন, বাম দিকে যেতে। কয়েকটি বাড়ি পরই একটি বাড়ির সামনে রিকশা থামিয়ে এক টাকা হাতে তুলে দিলেন। যে বাড়িটির সামনে আমরা দুজন, ঠিক তখনই দোতলা থেকে একজন ভদ্রলোক উচ্চস্বরে বললেন, ‘শহীদ এসেছিস, আমি আসছি।’ দেখলাম ভদ্রলোকের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, হাতে পাইপ। কিছুটা পরই দোতলা থেকে নেমে এলেন এক দীর্ঘদেহী সুপুরুষ।

১৯৬৫ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। পাইপ জ্বালিয়ে শেখ শহীদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর সঙ্গে ছেলেটি কে শহীদ।’ শহীদ ভাই জানালেন, ‘ও জগন্নাথ কলেজে পড়ে। বাড়ি পাবনায়।’ সেই দীর্ঘদেহী তখন বললেন, ‘তোদের কলেজের অধ্যাপক অজিত গুহ ভালো আছেন!’ জানালাম, ‘স্যার আমাদের স্পেশাল ক্লাস নেন।’ তিনি আরও জানতে চাইলেন, ‘তোদের প্রিন্সিপাল সাহেবের নাম যেন কী?’ বললাম, সাইদুর রহমান। একটু বিরতি দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘তোদের পাবনায় ক্যাপটেন মনসুরকে চিনিস।’ বললাম, ‘মনসুর চাচার ছেলে নাসিম আমার বন্ধু।’ কথা শেষে শহীদ ভাইকে ডেকে ঘরের বাইরে নিয়ে ৮-১০ মিনিট ওনারা দু’জনে কথা বলে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই শুনতে পেলাম, একজন ভদ্রমহিলা বাড়ির কাজের মেয়েকে বলছেন, ‘মোহন, মুরগি, আর কবুতরগুলিকে খেতে দে।’ ভদ্রমহিলা কথা শেষ করে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে দাঁড়াতেই সেই ভদ্রলোক তার ভরাট গলায় মহিলাকে ডেকে বললেন, ‘রেণু, এদিকে আসো, শেখ শহীদ এসেছে।’ রেণু নামের সেই ভদ্রমহিলা কিছুটা এগিয়ে আসতেই যিনি তাঁকে ডেকেছিলেন তিনি বললেন, ‘মা টুঙ্গিপাড়া থেকে যে পাটালি গুড় মুড়ি পাঠিয়েছেন ওদের দুজনকে খেতে দাও।’

মায়ামাখা তার কণ্ঠস্বর, যেন আমরা তার সন্তান, এই মাত্র খেলা শেষ করে ঘরে এসে পৌঁছেছি। পাটালি গুড় আর মুড়ি ড্রয়িং রুমে না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত তার সঙ্গে নানা টুকরো কথার একপর্যায়ে আমার ডান কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘লেখাপড়া ভালো করে করবি।’ যখন খাওয়া শেষে ওই বাড়ি থেকে বের হব, ঠিক সেই মহূর্তে আমার বাম কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘ভালো থাকিস। তোকে দেখতে অনেকটা কামালের মতো।’ ৩২ নম্বরের সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি আর শহীদ ভাই যখন রিকশায় উঠেছি, মিরপুরের রাস্তায় এসেই শহীদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কার বাড়িতে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘উনি আমার মামা, ওনাকে তুমি চেনো না?’ বললাম, ‘না।’ শহীদ ভাই একটু থেমে বললেন, ‘ওনার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ আমি তখন বললাম, ‘নাম শুনেছিলাম, কিন্তু স্বচক্ষে আগে কোনো দিন দেখিনি। আপনি যদি আগে বলতেন, আমি ওনার দুপায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম।’

আমার দুই হাতে জাতির পিতার দুই হাতের স্পর্শ, স্নেহ মমতার কথা যখনই মনে হয়; সেই ১৯৬৫ সালের কোনো একদিনের কথা আজ মনে পড়ে, তখন নিজের দুই চোখ বন্ধ করলে দেখি, সেই তাকে, দেখি তার মমতাময়ী স্ত্রী-কে; এখনো কানে ভেসে আসে, ‘টুঙ্গিপাড়া থেকে মা যে গুড়, মুড়ি পাঠিয়েছে, রেণু তুমি ওদের খেতে দাও!’ তার সেই মায়ামায় কণ্ঠস্বর, এত বছর পেরিয়েও যেন অনিঃশেষ স্নেহ হয়ে, মমতা হয়ে কানে বাজে।

অনুলিখন শুচি সৈয়দ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম