অশ্রুঝরা আগস্ট
আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মানুসন্ধানের দিন ১৫ আগস্ট

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উনিশ শ পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট আমাদের জন্য একটা ভয়াবহ দিন, স্তব্ধ করা শোকের দিন। পাশাপাশি আত্মানুসন্ধানেরও দিন। একটি জাতির যিনি স্বপ্নদ্রষ্টা, একটি জাতির মুক্তির জন্য যিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, যিনি আমাদের একটি স্বাধীন দেশের পতাকা দিয়ে গেছেন, তাকে এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তারই দেশের কিছু মানুষ-এটি আমাদের স্তব্ধ করে এবং আমাদেরকে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে। প্রশ্নগুলো আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দিকেও নিয়ে যায়। কেন এই নির্মম হত্যাকাণ্ড? এ কাজটি যারা করেছে, তারা কারা? কেন তাদের জিঘাংসা এত নিষ্ঠুর? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি। যারা এ কাজটি করেছে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, তারা পাকিস্তানের পরাজয়ে মর্মাহত, তারা একটি প্রতিক্রিয়াশীল বিশ্বাস থেকে এখন পর্যন্ত স্বপ্ন দেখছে পুনরায় সেই পাকিস্তানি পন্থায় ফিরে যাওয়ার।
পাকিস্তানের চব্বিশ বছর বঙ্গবন্ধু যে সংগ্রাম করেছেন, সেটা ছিল এক নব্য-উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম। এই সংগ্রামের একটা পক্ষে ছিল শক্তিধর একটি দেশ, তার সেনাবাহিনী পশ্চিমের মদদে পুষ্ট হয়ে দমন-পীড়ন, নিপীড়ন করে বাংলাদেশের মানুষের ওপর শাসকগোষ্ঠীর অন্যায্য ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়। এটি ব্রিটিশরা করেছে পরাধীন ভারতে এবং ১৯৪৭-এ দেশবিভাগ হওয়ার পর পাকিস্তানের সামরিক ও পুঁজিপতিচক্র তাদের শোষণের স্বার্থ বজায় রাখতে নয়া ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করে। তারা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাকে অস্বীকার করেছে, সংস্কৃতির অবদমন করেছে, অর্থনীতির অবদমন করেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের সব অধিকারকে তারা পদদলিত করেছে। এটি করতে গিয়ে তারা ধর্মকে ব্যবহার করেছে।
যে আত্মজিজ্ঞাসার কথা আমি বলেছি, এই গোষ্ঠীর মানস গঠন বোঝার জন্য তা জরুরি। এই ভয়ানক মানুষগুলোকে শিক্ষার আদর্শ স্পর্শ করেনি, সংস্কৃতির কোনো মূল্যবোধ তাদের স্পর্শ করেনি। এখনো যখন ওই মানুষগুলোকে সমর্থন দেয় কোনো এক তরুণ, এখনো যখন ধর্মকে ব্যবহার করে সহিংসতা ছড়ানো হয়-বুঝতে হবে আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এখনো তাদের মন জাগাতে পারেনি, তারা আগের সেই অন্ধকারেই ডুবে আছে। আত্মজিজ্ঞাসার যে কথাটি বলছি, সেটি আমাদের জাতিসত্তার ভেতরে দৃষ্টি নিক্ষেপের জন্য। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আমরা কি সেই পশ্চাৎগামী সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হতে পেরেছি? আমরা সেই ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির নিগড় ভাঙতে পেরেছি। তাহলে ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার মতো আরও ঘটনাও তো ঘটতে পারে।
যে শিক্ষা জাতিকে অগ্রগামী করে, এগিয়ে নিয়ে যায়, আলোর দিকে নিয়ে যায়-আমাদের সেই শিক্ষা চাই। আমাদের নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ করতে হবে। এসব না পারার জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আজও পশ্চাৎগামী। আমাদের শিক্ষার মধ্যে গলদ আছে। একটা স্বাধীন দেশে, নতুন সমাজ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন মানুষ গড়ার কাজে আমরা সফল হইনি। আর সেই ব্যর্থতার মাশুল আমরা আজ অবধি দিচ্ছি।
আমার মনে হয়, পনেরোই আগস্টের হত্যার ঘটনার কারণ শুধু প্রতিহিংসার ভেতরেই নিহিত নয়, এটি আছে এ ঘটনার কুশীলবরা কেন অন্ধকারের পথ বেছে নিল, এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেও।
আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে জাতির মানস পুনর্গঠনের দিকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত মানুষ তৈরির ব্যবস্থারূপে গড়ে তুলতে হবে। বাজারের জন্য, চাকরির জন্য নয় বরং উন্নত চিন্তাভাবনা, উন্নত কল্পনা এবং অনুসন্ধানী মানুষ তৈরির উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চাই। আমাদের সংস্কৃতিকে হতে হবে সেই সংস্কৃতি, যা মানুষের ভেতরের অন্ধকার দূর করে, মানুষকে সৃজনশীল শক্তিতে জাগাবে। আমাদের সমাজকে গতিশীল করতে হবে, যে সমাজে উন্নত নৈতিকতা স্থান পাবে এবং তা সম্ভব হলে একসময় অনৈতিকতা আর হিংস্রতার অবসান হবে। এগুলো যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে মানবিক প্রজন্মরূপে গড়ে তুলতে পারব, যারা এই স্বাধীন দেশটিকে সামনের দিকে, আলোর পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এ লক্ষ্যে আমি মনে করি, শিক্ষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য, একটা মেগা প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু এই কাজটিই শুরু করেছিলেন কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন গঠন করে। শিল্পকলা একাডেমি গঠন করে তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে শিল্প-সংস্কৃতিকে। নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে, নতুন সমাজের জন্য নতুন মানুষ তৈরি করতে।’ তিনি আমাদের বলেছিলেন, এক উন্নত সমাজ গড়ার জন্য সংস্কৃতিমান মানুষ প্রয়োজন, প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ প্রয়োজন। তিনি তার সূচনা করেছিলেন। আমি মনে করি, তার সেই দেখিয়ে যাওয়া পদক্ষেপগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি আমাদের এই সময়ে।
পনেরোই আগস্ট আমাদের সেই অঙ্গীকারের কথাই স্মরণ করায়।
অনুলিখন : শুচি সৈয়দ