দেশি-বিদেশি সবাই চায় সুষ্ঠু নির্বাচন
সমাধানে বড় বাধা আস্থার সংকট
হাবিবুর রহমান খান
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরগরম রাজনীতির মাঠ। নানা অনিশ্চয়তা থাকলেও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে বারবার প্রতিশ্র“তি দিচ্ছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নও চায় সুষ্ঠু নির্বাচন। প্রতিবেশী ভারত দীর্ঘদিন নীরব থাকলেও বৃহস্পতিবার দেশটি জানিয়েছে বাংলাদেশে অবাধ ও সংঘাতমুক্ত ভোট চায় তারা। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একই দাবিতে সমমনা দল নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে। দেশের সুশীল সমাজ, সচেতন মহলসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের চাওয়াও একই। তাহলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা কোথায়-ঘুরেফিরে সর্বত্র এমন আলোচনাই চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, রাজনৈতিক দল, পেশাজীবীসহ নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করে যুগান্তর। সবাই প্রায় অভিন্ন সুরে জানান, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বড় বাধা হচ্ছে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাব। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট তীব্র। নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি বেশিরভাগ দল ও মানুষের ভরসা নেই বললেই চলে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বাধাগুলো সমাধানে রাজনীতিবিদদের নজর নেই। যে কোনোভাবে ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য।
তাদের আরও অভিমত, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার নজির খুব কম। একমাত্র নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই দেশে তিনটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন তারা অন্যদের চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকার বারবার প্রতিশ্র“তি দিয়ে বিরোধী দলগুলোকে আস্থায় আনতে পারছে না। সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে একই প্রতিশ্র“তি দেওয়ার পর বিএনপি ভোটে অংশ নেয়। কিন্তু সরকার সেই প্রতিশ্র“তি রাখেনি বলে দাবি দলটির। তাই সরকারের আহ্বানকে এবার তারা আস্থায় নেবে বলে মনে হচ্ছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা। রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস এবং সর্বোপরি তাদের সদিচ্ছা ছাড়া এ বাধা কখনো দূর করা যাবে না। উলটো সংকট আরও ঘনীভ‚ত হবে। যার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্বাচন প্রশ্নে বড় দুটি দল নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। চলছে রাজপথ দখলের লড়াই। তা রূপ নিচ্ছে সহিংসতায়।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সবার মুখেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা নিশ্চিত করতে বহু বাধা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আন্তরিকতার অভাব। অতীতে একই প্রতিশ্র“তি দেওয়া হলেও তা রক্ষা করা হয়নি। নির্বাচন একদিনের বিষয় নয়-এটা একটা প্রক্রিয়া। সেটা যথার্থ নয়। নির্বাচনি প্রক্রিয়া যথার্থ এবং কারসাজিমুক্ত হতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ভুল নির্বাচনি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে তার অন্যতম হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, এরপর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরা নিরপেক্ষ না হলে কোনোদিন সুষ্ঠু ভোট হবে না। নিশ্চিত করতে হবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেটা কখনো সম্ভব হবে না। পাশাপাশি নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা অপরিহার্য।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট তৈরির পেছনে রয়েছে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতা। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার মধ্য দিয়ে সংকট ঘনীভ‚ত হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এক দল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চায়। অন্য দল চায় যে কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সদিচ্ছার অভাব। একটিই শব্দ, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ক্ষমতা হারিয়ে যাওয়ার ভয়। ক্ষমতায় থাকার আকাক্সক্ষা।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্ন ওঠে। বিনা ভোটে ১৫৪ জন নির্বাচিত, দিনের ভোট রাতে হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এসব নির্বাচনে ইসিসহ সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ড নিয়েও রয়েছে নানা সমালোচনা। বিএনপিসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে আগ্রহ কমে গেছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি বেশিরভাগ দল ও মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করে বিরোধী দলগুলো। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে শুরু করে আন্দোলন। সমমনা দল নিয়ে বর্তমানে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় তারা। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর দাবি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতেই তারা আন্দোলন করছে।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা ‘তোতা পাখি’র মতো বলে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের কথা শুধু দেশের মানুষ নয় বিদেশিরাও বিশ্বাস করে না। এ সরকার পুরো নির্বাচনি সিস্টেমটাই ধ্বংস করে দিয়েছে। যেনতেনভাবে ভোট করে জয়ী হওয়া কিংবা ক্ষমতায় যাওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য। জনগণের প্রতি তাদের কোনো আস্থা নেই। তাই নির্বাচনের মাঠে প্রতিপক্ষকে তারা মেনে নিতে পারে না। সবশেষ ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে হিরো আলমের মতো একজন প্রার্থীকেও তারা পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে।
তিনি বলেন, দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একমাত্র বাধা হচ্ছে এ সরকার। তাই অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে এ সরকারকে বিদায় নিতে হবে। একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই শুধু ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের বাইরে একচুলও সরবে না বলে অনড় রয়েছে। দুদলের বিপরীতমুখী অবস্থানে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। যা ইতোমধ্যে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিকে যাওয়ার শঙ্কা থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তারা বদ্ধপরিকর।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান যুগান্তরকে বলেন, শুধু এখন নয় বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সব সময় বড় বাধা বিএনপি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী জামায়াত। দলটি জানে কোনো নির্বাচনেই তারা জিততে পারবে না। দেশের উন্নয়ন ও জনগণের ক্ষতি করাই তাদের মূল কাজ। বিএনপি-জামায়াত ভাই ভাই। তাদের কর্মকাণ্ডেই প্রমাণ করে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নয়।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্র“তি বিশ্বাস করা যায় না-বিএনপির এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, তারা যে অভিযোগ করছে সেজন্য বিএনপির পাশাপাশি মিডিয়াও দায়ী। বিএনপি এমন অসত্য কথা বলেই আসছে আর মিডিয়া সেগুলো প্রচার করছে। ২০১৪ সালে বিএনপি শত শত নির্বাচনি কেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়েছে। ২০১৮ সালে ভোটে এসে পরে বলতে শুরু করল রাতের বেলা ভোট হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা একটি প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
এদিকে দুদলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের ক‚টনীতিকরা পর্দার আড়ালে তৎপরতা শুরু করে। একপর্যায়ে প্রকাশ্যেই শুরু হয় তাদের দৌড়ঝাঁপ। বিদেশি প্রায় সবার একটাই চাওয়া-অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে দেশটি বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। নির্বাচনে যারা বাধার সৃষ্টি করবে তাদের ভিসানীতির আওতায় আনা হবে।
ভিসানীতি ঘোষণার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সবশেষ বুধবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করতে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছুটে যান তিনি। ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পিটার হাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। কোনো ধরনের সহিংসতা চায় না তারা। কোনো রাজনৈতিক দলকে অন্য দলের চেয়ে বেশি গুরুত্বও দেয় না। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, সুশীল সমাজ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবারই ভ‚মিকা রয়েছে।