বিশেষজ্ঞদের অভিমত
রাজনৈতিক বিভাজনে বাড়ছে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ
রাজনীতিকরা দেশের মানুষকে বিশ্বাস করে না, করে বিদেশিদের -এম সফিউল্লাহ * সব দলই নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে -হুমায়ুন কবির * বিভাজনের রাজনীতিই বিদেশিদের জন্য জায়গা তৈরি করে দেয় -ইমতিয়াজ আহমেদ
হক ফারুক আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকেই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে। দেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে ইইউসহ পশ্চিমা ১৩ রাষ্ট্রের বিবৃতি, জাতিসংঘ, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যসহ নানা তৎপরতায় সরব রাজনৈতিক অঙ্গন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে, তাদের পালটাপালটি বক্তব্যে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের প্রাক-নির্বাচনি মিশন থেকে শুরু করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে প্রধান দুই দলের নেতাদের বৈঠক, নানা বক্তব্য থেকে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে নতুন প্রশ্ন। তারা বলছেন, রাজনৈতিক বিভাজনে বাড়ছে কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ। রাজনৈতিক দলগুলোর এই বিদেশি কূটনীতিককেন্দ্রিক তৎপরতার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, এতে প্রধান দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন বাড়বে না কমবে। তারা বলেন, আমাদের গণতন্ত্র এবং নির্বাচন নিয়ে ঘাটতির যে জায়গায় তৈরি হয়েছে, বিদেশি কূটনীতিকরা এর সুযোগ নিচ্ছে। এই ঘাটতির জায়গাটা মূলত তৈরি করে দেন রাজনীতিবিদরাই। তারা দেশের মানুষকে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে বিদেশিদের। ছুটে যায় তাদের কাছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, ভিয়েনা কনভেনশনে বলা আছে, একটি দেশে অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতরা আইনের মধ্য থেকে তার দেশের সম্পর্ক, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করবে। সেই তথ্য তার দেশের সরকারের কাছে পাঠাতে পারেন। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনাররা এসব কাজ করে থাকেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও দ্বিপাক্ষিক এই সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা আমাদের অংশীদার। সেই দিক থেকে তারা এ বিষয়গুলো নিয়ে কথাবার্তা বলেন।
ব্যাক্তিগত মতামত প্রকাশ করে তিনি বলেন, যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই বিষয়গুলো সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সমাধান করে ফেললে কূটনীতিবিদদের আর কথা বলার সুযোগ থাকে না। দায়টা শুধু তাদের কাছে না চাপিয়ে একটু নিজেদের দিকে দেখলে ভালো। তাতে আমাদের আত্মসম্মান রক্ষা হয় এবং শান্তিতে বসবাস করতে পারি। এই সংঘাত, সহিংসতা এগুলো দেশের জন্য ভালো নয়। এতে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে উৎসারিত জাতি হিসাবে আমার প্রত্যাশা, আমরা অন্যের বলার আগেই এই বিষয়গুলো নিয়ে নিজেরা চিন্তা করে যুক্তিসঙ্গতভাবে সবাইকে নিয়ে টেকসই সমাধানের দিকে যাব। তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলই নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে। তারা দেশের বিষয়ে কথা বলতে সুযোগ তৈরি করে দেয়। এটা এক পাক্ষিক বিষয় নয়। ক্ষমতার বাইরে-ভেতরে অতীতেও সব দলই এটি করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী এগুলোকে ব্যাখ্যা করে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্র বা নির্বাচন নিয়ে আমাদের ঘাটতি আছে। সেটা অস্বীকার করলে চলবে না। এই ঘাটতি মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়, বড় দলগুলোর নিজেদের মধ্যে কোনো আস্থা নেই। বিভাজনের রাজনীতি আছে। এই বিভাজন রাজনীতিই বিদেশিদের জন্য জায়গা তৈরি করে দেয়। যেসব দেশে ঘাটতি থাকে না সেসব দেশে রাষ্ট্রদূত বা মিশনপ্রধানরা তেমন কিছু বলতে পারে না। যেহেতু আমাদের ঘাটতি আছে সেহেতু তারা সুযোগটি পায়। সুযোগ আমরাই করে দিই। যারা বিরোধী দলে থাকে তখন স্বাভাবিকভাবে তারা নিজেদের অবস্থান ভালো করার জন্য, পত্রপত্রিকায় তাদের অবস্থা জনানোর জন্য, বিদেশিদের মধ্যে প্রচার পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা তুলে ধরেন। তাতে একটা বড় স্পেস তৈরি হয়।
তিনি বলেন, প্রশ্ন হতে পারে বিদেশিরা কতখানি গণতন্ত্রের চর্চা করে? কারণ অনেক দেশেই গণতন্ত্রের অভাব আছে। সেখানে তো অত উৎসাহ নিয়ে আসতে দেখা যায় না। তার মানে বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের বড় নজর পড়েছে। এটার বড় কারণ, গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেহেতু পরিবর্তন এসেছে, সেহেতু এখানে বড় ধরনের উন্নয়ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাতে বিদেশিরা যারা এতদিন ধরে বিনিয়োগ করেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে অন্যভাবে বললে যাদের স্বার্থ রক্ষা করার বিষয়ও আছে তারা সেটি রক্ষা করতে চায়। যেন সম্পর্কের মধ্যে কোনো ধরনের ঝামেলা তৈরি না হয়। গত ১৫ বছরে নজরে না এসে এখন নজরে আসার কারণ, পৃথিবী পরিবর্তন হচ্ছে। এ কারণে পশ্চিমা দেশগুলো চায় বাংলাদেশ যেন তাদের সঙ্গেই থাকে। কারণ তারা জানে, অন্যদেশগুলোও প্রতিযোগিতায় আছে।
তিনি বলেন, বিদেশিরা যে পদক্ষেপগুলো নেন সেগুলো আমাদের রাজনীতিবিদরা বোঝেন কিনা আমি জানি না। তারা বিভাজন বাড়ায়। তাদের সম্পৃক্ততা কোনোভাবেই বিভাজন কমায় না। এই বিভাজনটি বাড়ানোয় গণতন্ত্রের কী লাভ হয়? আমাদের রাজনীতিবিদদের কী লাভ হয় সেটাও বুঝতে পারি না।
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সব পরিবর্তন আমাদের জনগণই করেছে। কেনোভাবেই বিদেশিরা কোনো পরিবর্তন করতে পারেনি। তাহলে রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে না গিয়ে, বিদেশিদের কাছে কেন যায়। কী সরকারি দল বা বিরোধী দল। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, উভয় পক্ষই বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। নির্বাচনের আগ পর্র্যন্ত এটি চলবে বলে মনে করি। দুপক্ষই যেহেতু বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে সেক্ষেত্রে আসলে মিশন বা রাষ্ট্রদূতদের কোনো বিষয়ে দায়ী করে লাভ নেই। তিনি বলেন, এটি কখনো দেখিনি যে, নিজেদের নির্বাচনের বিষয়ে বিদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে উভয় রাজনৈতিক দল সারাক্ষণ লেগে থাকে। এটা বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। তিনি বলেন, রাজনীতিকরা আমাদের দেশের মানুষদের বিশ্বাস করে না। ভোটের বিষয়েও নয়। সব সময় মনে করে বিদেশিরাই সাহায্য করবে। বিদেশিদের সাহায্য প্রত্যাশাও করে। আমাদের দেশের রাজনীতি একটি নিু সংস্কৃতিতে চলে গেছে। এটি স্বাধীন একটি দেশের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অন্যান্য স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে রাষ্ট্রদূতরা রাজনীতিবিদদের খুঁজে বেড়ায়। আর আমাদের দেশে রাজনীতিবিদরা উলটো দূতাবাসগুলোর পেছনে ঘোরাঘুরি করে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ এবং এর ভৌগোলিক অবস্থান সব পরাশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একটি পরাশক্তি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাদের পররাষ্ট্রনীতির যে মূল লক্ষ্য তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ‘একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’। তাদের জিওপলিটিক্সের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। আরেকটি পক্ষ কর্তৃত্ববাদী। তারা নিজেরা কর্তৃত্ববাদী এবং কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা তাদের জন্য আকর্ষণীয়। তারা প্রকাশ্যে দৌড়ঝাঁপ করছে না। তারা মূলত সরকারের সঙ্গেই কথা বলছে। বিরোধী দলের সঙ্গে তারা কোনো মতবিনিময় করছে কিনা জানি না। অন্যদিকে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সরকার-বিরোধী দল সবার সঙ্গেই মতবিনিময় করছে।
পশ্চিমাদের যে আকাঙ্ক্ষা সেটি বাংলাদেশের আইন এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। কে সরকারপ্রধান হলো সেটি বিষয় নয়। অন্তরালের ইস্যু হলো মানুষের ভোটাধিকার। এটি বাংলাদেশের আইনে আমাদের স্বীকৃত অধিকার। গণতান্ত্রিক শাসনের পূর্বশর্ত। আমাদের সংবিধানের ১১, ৬৫, ৬৯ এসব অনুচ্ছেদে জনগণের প্রতিনিধিদের শাসন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনের কথা বারবার বলা আছে। আন্তর্জাতিক আইনেও এগুলো স্বীকৃত অধিকার এবং মানবাধিকার। আমরাও সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বস্তুত মানবাধিকার, নির্বাচন, ভোটাধিকার- এগুলো কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তীরণ বিষয় নয়। এটা সর্বজনীন অধিকার।
বর্তমানে বিদেশিরা এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে-কারণ আমরা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারছি না। আমরা আমাদের ঘর গোছাতে পারছি না। যা বলা হয় যে, এসব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পশ্চিমারা শুধু আমাদের ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে। এটা সঠিক নয়। ভারতের মানবাধিকার ইস্যুতে মোদির সঙ্গে কথা বলতে বাইডেনকে ৭৫ আইনপ্রণেতা চিঠি দিয়েছেন। যারা মার্কিন কংগ্রেসের সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্য এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা। তাদের মধ্যে একজন নেতা ভারতীয় বংশোদ্ভূত। চীনের বিষয়েও হয়েছে। তাই এটি ঠিক নয় যে, তারা কেবল বাংলাদেশের বিষয়েই আগ্রহী। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ হলো-আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করা উচিত। তা না হলে আমরা একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হতে পারি।