রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমাবেশে জনস্রোত
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বেলা আড়াইটা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। দুইটায় শুরু হওয়া বিএনপির মহাসমাবেশে তখন লোকে লোকারণ্য। চারদিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সব সড়কে শুধু মানুষ আর মানুষ। চলছে বিএনপি নেতাদের একদফা আন্দোলনের বিপ্লবী বক্তব্য। মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত পুরো এলাকা। হঠাৎ নামল ঝুম বৃষ্টি। কিন্তু সমবেত নেতাকর্মীরা অটল।
মহাসমাবেশে যোগ দেওয়া সবার লক্ষ্য মঞ্চের দিকে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে স্থির। ত্যাগী অনুগত কর্মীর মতো কেউ পিছু হটেনি। এমনকি মঞ্চে থাকা নেতারাও। সবাই কাকভেজা হয়েই মহাসমাবেশের গতি ধরে রাখেন পুরোটা সময়। উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার কাছে এমন দৃশ্য নজর কাড়ে।
সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে বড় ধরনের মহাসমাবেশ করল বিএনপি। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর স্বতঃস্ফূর্ত সমাগম ঘটে। এতে সাধারণ মানুষকেও অংশ নিতে দেখা গেছে। ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারাও। বিএনপির মতে, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মহাসমাবেশ।
আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরুর অনেক আগেই নয়াপল্টনসহ আশপাশের এলাকা লোকারণ্য হয়ে পড়ে। একদিকে মতিঝিলের শাপলা চত্বর মোড়, অন্যদিকে কাকরাইল মসজিদ ও মৌচাক মোড়, আরেকদিকে পল্টনের মোড় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের ঢল নামে। মূল সড়কে জায়গা না পেয়ে আশপাশের অলিগলিতে অবস্থান নেন নেতাকর্মীরা।
সমাবেশ উপলক্ষ্যে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আটটি ট্রাক দিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। সেখান থেকেই কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। ভোর থেকেই নয়াপল্টনে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করেন। সকাল ১০টার মধ্যে নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে দুপাশের সড়ক কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। তবে সকালে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই ছিলেন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা।
নেতারা জানান, মহাসমাবেশের জন্য রাজধানীতে আগে থেকেই বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মী অবস্থান করছিলেন। তারাই মূলত ভোর থেকে নয়াপল্টনমুখী হন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা থেকে নেতাকর্মীরা আসতে শুরু করে। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জসহ ঢাকা বিভাগীয় জেলার বিএনপি ও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখা যায়। তারা বাস, ট্রাক ও ট্রেনে করে ঢাকায় আসেন।
নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখতে সকাল ৮টা থেকেই অস্থায়ী মঞ্চ থেকে জাসাসের উদ্যোগে প্রতিবাদী গান ও কবিতা পরিবেশন করা হয়। প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে দুপুর ১২টার মধ্যে চারদিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নেতাকর্মীরা সমবেত হয়। এর মধ্যে জুমার নামাজ ও খাবারের জন্য পৌনে এক ঘণ্টার বিরতি দেওয়া হয়।
দুপুর দেড়টার দিকে পল্টন এলাকায় বৃষ্টি শুরু হলে মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসা কিছু নেতাকর্মী সড়ক ছেড়ে দোকানপাটের সামনে অবস্থান নেন। তবে বৃষ্টিতে ভিজেও অনেক নেতাকর্মী সড়কেই অবস্থান করেন। এ সময় নেতাকর্মীদের চাঙা রাখতে মূল মঞ্চ থেকে সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হয়। বেলা দুইটার কিছু আগে বৃষ্টি থেমে যায়। পরে নেতাকর্মীরা আবার সড়কে অবস্থান নেন।
দুপুর দুইটার দিকে কুরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় মহাসমাবেশ। আড়াইটার দিকে আবারও প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। এর মধ্যেই বক্তব্য চালিয়ে যান কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রায় আধা ঘণ্টা বৃষ্টির বাধা টলাতে পারেনি বিএনপি নেতাকর্মীদের। সমাবেশে অংশ নেওয়া নেতাকর্মী ও মূল মঞ্চে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও ভিজে যান। এ সময় দেখা যায়, অধিকাংশ নেতাকর্মী রাস্তায় অনড় ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বৃহস্পতিবার রাতেই সমাবেশস্থলে হাজির হন। তাদের মধ্যে অনেকে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচে ও ফুটপাতে মাদুর বিছিয়ে রাত পার করেন। ভোর হতেই রাজধানীতে অবস্থান করা নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে আসতে শুরু করেন।
সকাল ৮টার দিকে ময়মনসিংহ থেকে আসা বিএনপি কর্মী মো. আরিফ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন। আসতে কষ্ট হলেও মহাসমাবেশে এসে ভালো লাগছে।’
লালমনিরহাট থেকে আসা ফারহান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘১৫ বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছি। জনগণকে মুক্তি দিতে, গণঅধিকার ও ভোটের দাবি নিয়ে রাস্তায় এসেছি।’ আমাদের একদফা, এক দাবি; শেখ হাসিনার পদত্যাগ।’
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শোলক ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনির জমাদার জানান, ‘সকাল ৭টায় নয়াপল্টনে এসেছেন। তারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ডাকে দুদিন আগেই ঢাকা এসেছেন। এ আন্দোলন গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন।’
বরিশাল জেলা যুবদলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল মাহমুদ, একই জেলার উজিরপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান সোহাগ খান, শোলক ইউনিয়ন যুবদলের সোহাগ ফকির, সজিব মোল্লা, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এসএম ফরহাদ হোসেন জুয়েলও খুব সকালে অংশ নেন। তারা জানান, সরকার স্বৈরাচারের রূপ ধারণ করেছে, এই সরকার আর জনগণের সরকার নয়। শুধু বিএনপি নয়, সাধারণ মানুষও এ সরকারের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ। দেশের ৮০ ভাগ লোক এ সরকারকে এক মুহূর্ত ক্ষমতায় দেখতে চায় না। ফলে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথে থাকবেন।
সমাবেশে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। দুপুর ১২টার দিকে ভাসানী ভবনের সামনে কথা হয় পুরান ঢাকা থেকে আসা ব্যবসায়ী রিয়াদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি কোনো রাজনীতি করেন না বলে জানান। তবে বিএনপির দাবি যুক্তিসঙ্গত। এজন্য নেতাদের বক্তব্য শুনতে সমাবেশে এসেছেন। এত বড় সমাবেশ আর কখনো দেখেননি তিনি।’
এদিকে বিএনপি গঠিত স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল খুবই তৎপর। এজন্য সমাবেশে সুশৃঙ্খল ছিল নেতাকর্মীরা। ঢাকা মহানগরসহ সব জেলার নেতাকর্মীরা কোন জায়গায় অবস্থান করবেন তাও ছিল নির্ধারিত। সে অনুযায়ীই তারা অবস্থান করেন। সমাবেশকে কেন্দ্র করে নয়াপল্টন ও এর আশপাশের এলাকার সড়কের মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। বিকাল সাড়ে ৬টার দিকে শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয় বিএনপির সমাবেশ।