জিবি সদস্যের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী বিয়ে
ভাবমূর্তি সংকটে আইডিয়াল স্কুল, উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী সিনথিয়া ইসলাম তিষাকে একই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির ষাটোর্ধ্ব সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদের বিয়ের ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। তারা নিজ নিজ কন্যার নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। দীর্ঘদিন ছাত্রীটির পেছনে লেগে থেকে এই বৃদ্ধ বিয়ে করেন।
এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশিদী দুজনকে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়াসহ সহায়কের ভূমিকা পালন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিয়েটি প্রথমে ছাড়াছাড়ি, পরে তালাক প্রত্যাহার এবং শেষ পর্যন্ত পালটাপালটি জিডি ও উচ্চ আদালতে গড়ায়।
অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, পরিচালনা কমিটির সদস্য কর্তৃক ছাত্রী বিয়ে করার ঘটনার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। এখন মতিঝিল আইডিয়ালের এই ঘটনার বিচার না হলে একদিকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চরিত্রহীন সদস্যদের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে, অন্যদিকে দেশের অন্যতম সেরা এই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও চরম সংকটের মুখে পড়েছে।
এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবীর দুলু বুধবার যুগান্তরকে বলেন, নাতির বয়সি একটি বাচ্চাকে পরিচালনা কমিটির সদস্যের এভাবে বিয়ের ঘটনা বিনা বিচারে পার পাওয়া উচিত নয়। তাহলে এ ধরনের ঘটনা সারা দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। আরও অনেক খন্দকার মুশতাকের জন্ম হতে পারে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়বে ছাত্রীদের জন্য। পাশাপাশি এ ঘটনা আইডিয়ালের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিও চরম ক্ষুণ্ন করেছে। তিনি আরও বলেন, ছাত্রীর বয়স যা-ই থাকুক না কেন, বিয়ের হলফনামাই প্রমাণ করে যে, ছাত্রীটি নাবালক থাকাকালে ওই জিবি সদস্য সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর যে ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে তাতে অধ্যক্ষ দায়ভার কিছুতেই এড়াতে পারেন না। এই দুজন আবার সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু। বিয়ের জন্য না হলেও স্কুলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অপরাধেও উভয়ের বিচার হতে পারে।
জানা গেছে, ঢাকা ও আশপাশে শত শত পিকনিক স্পট থাকা সত্ত্বেও গত ১৮ মার্চ আইডিয়ালের কলেজ শাখার শিক্ষা সফর করা হয় উল্লিখিত খন্দকার মুশতাকের নরসিংদী এলাকায় অবস্থিত বাগানবাড়িতে। আর এই আয়োজনের মূল ভূমিকা পালন করেছেন অধ্যক্ষ। ওই অনুষ্ঠানে ছাত্রীরা কলেজের ইউনিফর্মে যোগ দিলেও তিষা সাধারণ পোশাকে ছিলেন। অধ্যক্ষ বিষয়টি অনুমোদন দেন। এ নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে যত রহস্য। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো ছবিতে খন্দকার মুশতাক, অধ্যক্ষ এবং তিষাকে একই ধরনের গাদা ফুলের মালা পরিহিত দেখা যায়। এছাড়া অধ্যক্ষ মাঝখানে থেকে তিষা এবং খন্দকার মুশতাককে দুই পাশে রেখে অট্টহাসিসহ তোলা ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। এসব থেকেই এই ঘটনার পেছনে অধ্যক্ষের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হচ্ছে। এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর ২৫ মার্চ দুজনে কোর্ট ম্যারেজ করেন। তাতে দুজনের দীর্ঘদিন ভালোবাসার কথা উল্লেখ আছে।
তিষার বাবা সাইফুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, সব ঘটনার পেছনে আছেন অধ্যক্ষ। তিনি কেবল আমার মেয়ের জীবনই নষ্ট করেননি। স্কুলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করেছেন। তার বিচারের দাবিতে অভিভাবকরা শিগগিরই মানববন্ধন করবেন।
জানা যায়, ছাত্রীটির সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ পেলেও খন্দকার মুশতাক বা ছাত্রীটি প্রথমে এই বিয়ের বিষয়টি স্বীকার করেননি। জুনের প্রথম সপ্তাহে এ নিয়ে যুগান্তর কথা বললেও স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেননি খন্দকার মুশতাক। এমনকি ওই সময়ে ফেসবুকে এসে দেওয়া লাইভেও তিষা স্বীকার করেননি। এ অবস্থায় এই ঘটনা পরিচালনা কমিটির দৃষ্টি আনতে মে মাসের শেষ সপ্তাহে একজন অভিভাবক কমিটির সভাপতি বরাবর লিখিত দেন। পরে ঘটনা ধামাচাপা দিতে ৩১ মে অনুষ্ঠিত জিবির সভায় ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মমতাজ বেগমকে দিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে ৩১ মের পর থেকে যখন বিয়ে স্বীকারের বিষয়ে নাটকীয়তা চলছিল, তখন হঠাৎ ১১ জুন খন্দকার মুশতাককে তালাকের নোটিশ পাঠান তিষা। বিষয়টি গণমাধ্যমে তিষার পরিবারই প্রকাশ করে। ওই নোটিশে লেখা হয়, খন্দকার মুশতাক একজন বদমেজাজি, নারীলোভী। তাকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন তিনি। এ বিয়ে তিনি মানেন না, তার সঙ্গে তিনি সংসার করতে চান না। এতে তাকে প্রলুব্ধ করার কথাও আছে। কিন্তু এর দুদিন পর ১৩ জুন ফের তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে নেন ছাত্রীটি। সেখানে তিনি লেখেন, তালাকের ওই নোটিশ তার বাবা-মা জোর করে পাঠিয়েছেন। তার কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিষার বাবা সাইফুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, মেয়েসহ তার পরিবার ঠাকুরগাঁওয়ে ছিল। সেখান থেকে তার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে আসেন খন্দকার মুশতাক। আগে থেকেই গাড়ি প্রস্তুত ছিল। অনেক রাতে তার কন্যাকে তুলে নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, তিষাকে সব ধরনের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। তার পরিবারের কেউ কথা বলতে পারছে না।
তবে ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। ওই মামলায় গ্রেফতার থেকে বাঁচতে খন্দকার মুশতাক উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নেন। এছাড়া তিষা তার বাবা সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। এসব বিষয়ে খন্দকার মুশতাক বুধবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, তিনি তার স্ত্রীকে অপহরণ করেননি। বরং তিনি স্বেচ্ছায়ই তার কাছে ফিরে এসেছে। তিনি উলটো সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে তার স্ত্রীকে (তিষা) মারধর এবং নির্যাতন করে তালাক নোটিশ পাঠাতে বাধ্য করার অভিযোগ করেন। এ সময় তিনি তিষার সঙ্গে এ প্রতিবেদককে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোন হস্তান্তর করেন। তখন তিষা দাবি করেন, তাকে আটকে রাখা বা পরিবার থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার অভিযোগ সঠিক নয়। বুধবারও পরিবারের একজনের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, তার দাম্পত্য জীবনে তার বাবা বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। এজন্য তিনি থানায় জিডি করেছেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেও অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশিদীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মুশতাক বলেন, অধ্যক্ষ ফৌজিয়া রাশিদী তার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু। কোথাও ভেন্যু খালি না পাওয়ায় ও তহবিল সংকট থাকায় বিনামূল্যে তার বাগানবাড়িতে শিক্ষাসফর করা হয়েছে। এই বিয়ের পেছনে অধ্যক্ষের ভূমিকা নেই। তিষা তার সঙ্গে সংসার করছে। ‘অন্য স্কুলে তার এ দৃষ্টান্ত সংক্রমিত হবে কি না’-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কখন কার কাকে ভালো লাগবে, তা আগাম বলা যায় না। এখানে বেআইনি কিছু ঘটেনি। তাহলে তিনি জামিন পেতেন না। বরং তার ঠিকানা হতো কাশিমপুর।’