Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

শাহজালালের তিন সুইপার গাড়ি অকেজো

ঝুঁকিপূর্ণ রানওয়েতে বিমান ওঠানামা

ঝাড়ু দিয়ে চলছে পরিচ্ছন্নতা * আইকাও’কে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো

Icon

মুজিব মাসুদ

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঝুঁকিপূর্ণ রানওয়েতে বিমান ওঠানামা

ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে। নিরাপদ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের স্বার্থে রানওয়েটি পরিষ্কারের জন্য তিনটি সুইপিং গাড়ি থাকলেও সবক’টিই অকেজো। এর মধ্যে দু’টি ৭ বছর ধরে নষ্ট হয়ে গ্যারেজে পড়ে আছে। আরেকটি তিন মাস ধরে নষ্ট। বাধ্য হয়ে রানওয়ে চলমান রাখতে হচ্ছে ম্যানুয়ালি ঝাড়ু দিয়ে।

গত বছর ১৯ ডিসেম্বর শাহজালালের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জরুরি ভিত্তিতে দুটি অত্যাধুনিক সুইপার গাড়ি ক্রয়ের জন্য বেবিচককে চিঠি দিলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাও নেই।

এমন পরিস্থিতিতে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনকে (আইকাও) চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ এ অবস্থাকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে তারা। তারা বলছেন, একটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০-ইআর এয়ারক্রাফটের দাম ১২শ’ থেকে ১৫শ’ কোটি টাকা। শাহজালালের ঝুঁকিপূর্ণ রানওয়ের কারণে যদি কোনো এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনায় পড়ে সেজন্য সিভিল এভিয়েশন দায়ী থাকবে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরাও এরকম পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। তারা জানান, নিয়ম হলো- বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের পর দ্রুতগামী সুইপিং গাড়ির মাধ্যমে রানওয়ে পরিষ্কার করা। এ ছাড়া সপ্তাহে অন্তত ২ বার ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ রেখে রানওয়ে ক্লিন করতে হয়। কারণ বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের পর রানওয়েতে নুড়ি পাথর তৈরি হয়। এছাড়া অনেক সময় বিমানের অনেক পার্টস, ধ্বংসাবশেষ (এফওডি) এবং ক্ষতিকর বস্তু রানওয়েতে পড়তে পারে। যেগুলো উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় চরম ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অনেক পুরোনো হওয়ায় রানওয়ে সুইপার গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন পার্টস কিনেও সচল করা যাচ্ছে না। এসব গাড়ি কেনাকাটা ও পরিচালনা নিয়ে অনেক সমস্যা হয়। এ কারণে আমরা আগামীতে রানওয়ে ক্লিনিংয়ের কাজ আউট সোসিংয়ের মাধ্যমে করতে চাচ্ছি। তাহলে কাজের মান আরও ভালো হবে। তবে নিরাপত্তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে। কারণ বেসরকারি কোম্পানিকে দিয়ে রানওয়ের মতো কেপিআই (কী পয়েন্ট ইন্সটলেশন) স্থাপনা পরিষ্কার করানোও ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি বলেন, আপাতত দ্রুততম সময়ের মধ্যে কয়েকটি ইউরোপিয়ান মানের ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আশা করছি ১০-১৫ দিনের মধ্যে এগুলো ক্রয় করা সম্ভব হবে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইকাও’র রুলস অনুযায়ী বিমানবন্দরের রানওয়ে নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। বিমানবন্দরের ক্যাটাগরি আপডেট করারও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ প্রতিটি উড্ডয়ন অবতরণের পর রানওয়েতে ধ্বংসাবশেষ, রাবার ঘর্ষণ, বালি, নুড়িপাথর বা আলগা জিনিস পড়ে থাকে। এ ছাড়া অ্যাপ্রোন ও ট্যাক্সিওয়েতে পাথর, তেল, ক্যান, বোতল, পেরেক, প্লাস্টিক ব্যাগ, সুটকেসের চাকা, হাতল, তালা ও লাগেজট্যাগ পড়ে থাকে। সাধারণত এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিনগুলো চলমান অবস্থায় সহজেই মাটিতে পড়ে থাকা এসব আলগা উপাদান শোষণ করতে পারে। এতে ইঞ্জিনের প্রপেলার বা কম্প্রেসার ব্লেডের মারাত্মক ক্ষতি হয়। উড়ন্ত অবস্থায় মাঝ আকাশে প্রপেলার বা জেট ইঞ্জিন বিস্ফোরণের ঝুঁকিও থাকে এসব বস্তুর কারণে।

জানা জায়, বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সুইপাররা ঝাড়ু দিয়ে রানওয়ে ও আশপাশের এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখছেন। কিন্তু এতবড় রানওয়েকে ম্যানুয়েলি ঝাড়ু দিয়ে সচল রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঝাড়ু দিয়ে অনেক এফওডি ক্লিন করাও সম্ভব নয়। উলটো এটি আরও বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।

এ সম্পর্কে বিমানের সাবেক পাইলট ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদ বলেন, ‘রানওয়ে পরিষ্কারের কাজটি খুবই টেকনিক্যাল ও দুরূহ। একটি এয়ারক্রাফট যখন রানওয়েতে অবতরণ করে তখন তার প্রতিটি টায়ার রানওয়েতে ১.৫ পাউন্ড পর্যন্ত কালো রাবার ছেড়ে দেয়। একটি এয়ারবাসের (এ-৩৮০) ২২টি চাকা থাকে। অবতরণের সময় ঘর্ষণে এসব চাকার রাবার রানওয়ের পৃষ্ঠকে কালো ও মসৃণ করে তোলে। রানওয়েতে থাকা বিভিন্ন লাইনের সাদা বা বিভিন্ন কালারের দাগগুলোকে ঢেকে দেয়, যা একটি ফ্লাইটের নিরাপদ অবতরণের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি দ্রুতগামী প্লেনের টায়ার রানওয়ের কংক্রিটে আঘাত করলে এর ঘর্ষণ প্লেনকে ধীর করে দেয়। কিন্তু রানওয়ে যত মসৃণ হবে ঘর্ষণ তত কম হবে। ঘর্ষণ ছাড়া একটি প্লেন থামানো ও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এতে অনেক সময় এয়ারক্রাফট রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে। এছাড়া দুর্ঘটনা ক্রমে রানওয়ে বা প্ল্যান স্ট্যান্ডে তেল বা জ্বালানি ছিটকে পড়লে তা রানওয়েতে গুঁড়া ও দানাদার উপাদান তৈরি করে। ভেজা অবস্থায় রানওয়ের লাইন দেখা যায় না। এসব রাবার ম্যানুয়ালি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা অসম্ভব। গরম পানি স্প্রে করে সুইপিং মেশিন দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করতে হয়।’

শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরের রানওয়ে, টেক্সিওয়ে, অ্যাপ্রোন ও কার্গো ভিলেজ এলাকা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে আগে তিনটি রানওয়ে সুইপার গাড়ি ছিল। এর মধ্যে রানওয়ে সুইপার এলজিন (মডেল নং-০৮২৫কে) ২০০৬ সালের ১৬ মার্চ কেনা হয়। ১০ বছর চলার পর ২০১৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ে। এরপর থেকে গাড়িটি এমটি পুলের গ্যারেজে ফেলে রাখা হয়েছে।

ওই বছরের ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্লোয়ার বেইজড রানওয়ের দ্বিতীয় সুইপার গাড়ি (মডেল নং-সিআর-৪৫০ডি) ক্রয় করা হয়। মাত্র ৮ মাস যেতে না যেতে সেটি পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। জোড়াতালি ও স্পেয়ার পার্টস দিয়েও সচল করা সম্ভব হয়নি। এরপর ওই গাড়িটি শাহজালালের ফায়ার স্টেশনের গ্যারেজে ফেলে রাখা হয়।

তৃতীয় রানওয়ে সুইপার মেশিনটি ইতালি থেকে ক্রয় করা হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে ক্রয়ের পর থেকেই গাড়িটি বেশির ভাগ সময় নষ্ট থাকে। এটি সচল রাখতে মাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। গাড়িটি ২০১৫ সালে ক্রয় করা হয়। একটানা চলার কারণে গাড়িটির সুইপিং কাজের ক্ষমতা শতভাগ কমে গেছে। বর্তমানে ওই গাড়িটিও নষ্ট অবস্থায় বিমানবন্দরের বে-এলাকায় পড়ে আছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী অক্টোবর মাস থেকে চালু হবে শাহজালালের থার্ড টার্মিনালের একটি অংশের অপারেশনাল কার্যক্রম। তখন বিমানবন্দরের আয়তন দ্বিগুণ হবে। এ অবস্থায় যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সের স্থানীয় জিএসএস মালিক যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা-যাওয়া করা একেকটি উড়োজাহাজ অনেক মূল্যবান। এগুলো সুরক্ষার দায়িত্ব সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের। কয়েক কোটি টাকার একটি রানওয়ে সুইপার না থাকায় ১২-১৩শ কোটি টাকার উড়োজাহাজ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

তিনি বলেন, এমনিতেই আমরা গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সেবাসহ নানা খাতে অবহেলিত। ডলার সংকটের কারণে টিকিট বিক্রির টাকা ফেরত নিতে পারছি না। এখন আবার বড় সমস্যা অনিরাপদ রানওয়ে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম