১০ প্রতিষ্ঠানের লোকসান ২১ হাজার কোটি টাকা
১৮ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ঋণ ৬০ হাজার কোটি টাকা * রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের
মনির হোসেন
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় ১০ করপোরেশনের লোকসান ২০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি)।
আলোচ্য সময়ে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ৭০৮৭ কোটি টাকা। এছাড়াও মোট ৩০টি করপোরেশনের মধ্যে ১৮টির কাছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ৫৯ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কাছে। আলোচ্য সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা ১৩ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা।
এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশই খেলাপি। অর্থাৎ ঋণ নিয়ে তারা বছরের পর বছর পরিশোধ করতে পারছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন বিভিন্ন কারণে সরকারি করপোরেশনগুলোর ঋণ ব্যবহারে বড় ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব, কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় ট্রেড ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়।
তবে তাদের মতে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও এখানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ফলে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের পক্ষে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলোর দায়দেনা ও লোকসানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কখনই বিষয়টিকে জোরালোভাবে দেখা হয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, সংস্থাগুলোর লোকসান অব্যাহতভাবে বাড়ছে। তারা ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করে না। এদের রাজস্ব দায়বদ্ধতা লাখ লাখ কোটি টাকা। এসব সংস্থাকে কীভাবে লাভজনক করা যায় সে বিষয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। তিনি বলেন, এ খাতে এত বেশি লোকসান না দিলে টাকাগুলো উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা যেত।
কোন প্রতিষ্ঠানের কত লোকসান : ২০২২-২৩ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত সরকারি ১০ প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ ২০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে লোকসান ৭ হাজার ৮৭ কোটি, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ৬ হাজার ৯৬৯ কোটি, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ৫ হাজার ৫৬৩ কোটি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল করপোরেশন ১৬ কোটি ৬৬ লাখ, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) ৬৭৮ কোটি, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি) ২৪৮ কোটি, বিআরটিসি ৫০ কোটি, বিএফডিসি ২০ কোটি ৭৮ লাখ এবং বিআইডব্লিউটিএ’র লোকসানের পরিমাণ ৭২ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
কোন প্রতিষ্ঠানের কত ঋণ : অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যে দেখা গেছে-২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ কোম্পানির ঋণ ৫৯ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
এরমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের ১৩ হাজার ৮৭৮ কোটি, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ ৯ হাজার ৬৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ৮ হাজার ৫৬৯ কোটি, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ঋণ ৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ৪ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা, বিআইডব্লিউটিসি ৪৮৭ কোটি ৭৬ লাখ, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল শিল্প করপোরেশন ১৭৭ কোটি, বিটিএমসি ২৫ কোটি, বিজেএমসি ৬৫৫ কোটি, বিওজিএমসি ৪৩৫ কোটি, ঢাকা ওয়াসা ১৯ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৪৮ কোটি, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫৬৭ কোটি, বাংলাদেশ টেলিভিশন ৪ কোটি ৬২ লাখ এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কাছে ১০৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। আবার এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আবার ১৫টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে সরকারি শিল্প করপোরেশন লোকসান দেয়। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, ট্রেড ইউনিয়নের অযাচিত হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, পেশাদারিত্বের অভাব, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা ও অধিক উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, কোম্পানি লাভজনক হওয়ার জন্য উন্নত ব্যবস্থাপনা দরকার। আর ব্যবস্থাপনায় সংকট থাকলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরও কোম্পানি লাভজনক হতে পারবে না। তিনি বলেন, কোনো কোম্পানির হিসাবেও ঝামেলা রয়েছে।
কিন্তু কোম্পানি লিস্টেড হলে তার হিসাব স্বচ্ছ থাকে। অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণ বলছে, এ ধরনের করপোরেশনের ব্যাপারে মানুষের এ ধরনের আস্থা নেই। ফলে আস্থা পুনরুদ্ধার ছাড়া কোম্পানি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা কম। সংস্থাটি মনে করছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান লাভজনক করতে সরকারের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা করা হবে।
অন্যদিকে প্রাইভেটাইজেশন কমিশন গঠনের পর এ পর্যন্ত ৭৭টি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে এরমধ্যে ৩১টিই বন্ধ। ওই সময়ে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বেশকিছু কারণে প্রতিষ্ঠানে লোকসান হয়। এরপর প্রাইভেটাইজেশন কমিশন ভেঙে অনেক আগেই বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি।