সচল হচ্ছে পুরোনো মামলা, সাজার আতঙ্কে বিএনপি নেতারা
আন্দোলন দমনে চাপে রাখার কৌশল বলছে দলটির নীতিনির্ধারকরা * এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, নতুন করে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি-দুদক আইনজীবী

হাবিবুর রহমান খান
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মামলার জালে বন্দি হয়ে পড়েছে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূলের সক্রিয় কোনো নেতাই মামলা থেকে রেহাই পাননি।
বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ১ লাখ ১২ হাজারের মতো মামলা হয়েছে। এতে আসামি প্রায় ৪০ লাখ। বেশিরভাগ মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। এরসঙ্গে সচল হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেন ও পরবর্তী সময়ে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুর্নীতির পুরোনো মামলা। শুরু হয়েছে বিচারকাজও।
এসব মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে দ্রুত রায় দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা দলটির নেতা ও আইনজীবীদের। সম্প্রতি বিচারিক আদালতে দেওয়া সাবেক দুই মন্ত্রীর ১৩ ও ৯ বছরের সাজা উচ্চ আদালত বহাল রাখায় নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাঁজ।
তারা মনে করেন, নির্বাচনের আগে অনেক মামলার রায় দেওয়া হতে পারে। তাতে সাজা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মামলার মেরিট নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু আদালত রায় দিলে তা অমান্য করার সুযোগ নেই। তবে দলটির নীতিনির্ধারকদের দাবি, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার পুরোনো খেলা শুরু করেছে। মামলা ও সাজার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমাতে চাইছে।
বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত বিএনপির বিরুদ্ধে করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা প্রায় ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮১। আর অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। মোট মামলার মধ্যে দুই হাজার ৮৩০টির বেশি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এরমধ্যে রয়েছে কয়েকশ গায়েবি মামলাও।
আরও জানা গেছে, ১৯ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৬২টি নতুন মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৫ হাজার ৯০০। এ সময় সারা দেশে বিএনপির ৭২০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৫ দিনে জেলা পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ৮০০ নেতাকর্মীকে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, সরকারের কোনো জনভিত্তি নেই। তারা প্রশাসন ও আদালতকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে আছে। ভবিষ্যতে তা আরও দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা তৈরি করছে। এর অংশ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে এসব মামলা। এক হাজার ৩০০ মামলা বাছাই করে আগামী নির্বাচনের আগেই বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠাতে চায়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ছাড়া খালি মাঠে গোল দেওয়া সহজ হবে।
তিনি দাবি করেন, শুধু এ সরকারের আমলে দায়েরকৃত মামলা নয়, ওয়ান-ইলেভেনের সময় তথাকথিত দুর্নীতির মামলাগুলোও সচল করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদের দুজন সিনিয়র নেতাকে বিচারিক আদালতে দেওয়া সাজা বহাল রেখেছেন উচ্চ আদালত।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী ড. জোবাইদা রহমানের মামলাও চালু করেছে। দ্রুত রায় দিতে প্রায় প্রতিদিন এ মামলায় সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। রাতেও সাক্ষ্য নেওয়ার নজির স্থাপন করছে। অথচ ওয়ান-ইলেভেনের সময় একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের খালাস দেওয়া হচ্ছে।
ওয়ান-ইলেভেনের দায়ের করা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাবরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই বছর ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।
আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজা হয়েছে সাত বছর। দুই বছরের বেশি কারাভোগের পর সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দণ্ডপ্রাপ্ত।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় করা মামলায় সম্প্রতি হাইকোর্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নয় বছরের, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের ১৩ বছর ও তার স্ত্রী সাবেরা আমানের তিন বছরের সাজা বহাল রেখে রায় দিয়েছেন।
বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা জানান, ওয়ান-ইলেভেন ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি নেতাদের নামে করা দুর্নীতির অনেক মামলা বাতিলে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন তারা। উচ্চ আদালত অনেক মামলাই বিচারিত কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। দীর্ঘদিন এসব মামলার বিচারকাজ বন্ধ ছিল।
সেই মামলাগুলো পুনরায় সচল হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, সাবেক এমপি হাফিজ ইব্রাহিমের নামে করা দুর্নীতি মামলার বিচার চলবে বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
হাফিজ ইব্রাহিমের মামলাটি ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ফলে বিচারিক আদালতে মামলাটি চলতে আর কোনো বাধা নেই। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের দুর্নীতি মামলা আগেই সচল হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু যুগান্তরকে বলেন, মামলা নিয়ে সরকারের টার্গেট পরিষ্কার। বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে খালি মাঠে আবার গোল দিতে চাচ্ছে। কিন্তু এবার সেটা সহজ হবে না।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী ও দলের যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন যুগান্তরকে বলেন, বিরোধী দলকে দমনে সরকার আদালতকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে সরিয়ে দেওয়ার পর বিচার বিভাগে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সরকার আদালতে প্রভাব বিস্তার করে সিনিয়র নেতাদের সাজা দিয়ে নির্বাচনের অযোগ্য করতে চাচ্ছে। একইসঙ্গে বিএনপির মাঠপর্যায় এবং সহযোগী সংগঠনের সক্রিয় নেতাকর্মীদের শাস্তি দিয়ে আন্দোলন স্তিমিত করার কৌশল নিয়েছে। মূলত বিএনপিকে চাপে রাখতে সরকার এসব করছে।
তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো বাতিল করা হলেও খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের মামলা বহাল রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এখন এ মামলাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে বিএনপির অভিযোগ মানতে নারাজ দুদকের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মামলার ক্ষেত্রে আমরা বিএনপি বা আওয়ামী লীগ নেতা দেখি না। বিএনপি নেতাদের মামলাগুলো ১০ বছর ধরে শুনানির জন্য তালিকায় রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কৌশলে বিলম্বিত করা হচ্ছিল।
এখন সামনে আসছে। নতুন করে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটা আমাদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এখন অ্যাক্সিডেন্টলি যদি বিএনপির মামলা চলে আসে তাহলে আমার করার কিছু নেই। তিনি বলেন, সরকার আমাদের দিয়ে মামলাগুলো পরিচালনা করায়। কিন্তু আমি কখনো রাজনীতি করি না। কেউ বলতে পারবে না আমি আওয়ামী লীগের দলীয় কোনো কর্মসূচিতে কখনো অংশ নিয়েছি।
এখন কেউ যদি আমাকে রাজনীতির পাল্লায় ফেলেন সেটা সঠিক নয়। বিএনপি নেতা ও তাদের আইনজীবীরা দাবি করছেন, নিম্ন আদালতে কয়েকশ মামলা দ্রুত বিচারের কাজ চলছে। কয়েকদিন পরপর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করা হচ্ছে। এমনকি কোনো মামলায় দিনে তিন-চারজনের সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। এই নিয়ে সম্প্রতি আদালত এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নাল আবেদীন মেজবাহ যুগান্তরকে বলেন, বিরোধী দলকে দমনে সরকারের বড় অস্ত্র হচ্ছে মামলা। নিম্ন আদালতকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের দ্রুত সাজার ভয় দেখাচ্ছে।
তিনি বলেন, পাঁচ শতাধিক মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় সিনিয়র থেকে জুনিয়র নেতারা আসামি। মামলাগুলো দ্রুত শেষ করতে ঘন ঘন তারিখ দেওয়া হচ্ছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণও নেওয়া হচ্ছে দ্রুত।
তিনি বলেন, দ্রুত রায় দিয়ে নেতাদের সাজা দেওয়ার টার্গেট রয়েছে সরকারের। কিন্তু চেষ্টা করেও হয়তো সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। মানবিক দিক বিবেচনা করে বিচারকরা শেষ মুহূর্তে ভুলপথে পা দেবেন না। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতিও কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে। জোর করে সাজানো মামলায় রায় দিলে ইতিহাস সাক্ষী হয়ে থাকবে। এটা খারাপ উদাহরণ হবে।