Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

দলীয় কোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ

সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, এই প্রবণতা ততই বাড়বে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা

Icon

আবদুল্লাহ আল মামুন

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দলীয় কোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ

অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতাকর্মীরা এখন সারা দেশে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে পালটাপালটি অভিযোগ ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে কাদা ছোড়াছুড়ির সঙ্গে মাঠ দখলের লড়াইয়ে চলছে পেশিশক্তির প্রদর্শনী।

তৃণমূলের সম্মেলন, সিটি করপোরেশন ও সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন এলাকায় কোন্দল বেড়েছে। দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে সৃষ্ট বিরোধ সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। খুন হচ্ছেন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর এসব খুনের অভিযোগ উঠছে ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। গ্রেফতারও হচ্ছেন শাসক দলের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে চিন্তিত দলের হাইকমান্ড।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারি দলের নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগত নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ফলে দলটির মধ্যে কোন্দল বাড়ছে। আর এই কোন্দল থেকেই হচ্ছে খুনোখুনি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেতাকর্মীদের মধ্যে পাওয়া-না-পাওয়া থেকে ক্ষোভ ও মতবিরোধ এবং অন্তর্কলহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ।

তাদের মতে, আওয়ামী লীগের পদ-পদবি পেলে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। আর এ কারণেই তারা যে কোনো উপায়ে কাক্সিক্ষত পদ-পদবি পেতে মরিয়া হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসবে, এই প্রবণতা ততই বাড়বে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এখন দলটিতে আলোচনার প্রধান বিষয়। অনেকটা মাথাব্যথারও কারণ এটি। নির্বাচনের আগে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরোধ মেটাতে ব্যস্ত।

ইতোমধ্যে দলীয় কোন্দলে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী। বরিশালে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী জটিল পরিস্থিতিতে পড়েছেন। সেখানে বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে বাদ দিয়ে তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আবুল খায়ের আবদুল্লাহর দলীয় কোনো পদ নেই। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহ। তার বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। পুরো বরিশাল বিভাগের আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে নিজের ভাই ও ভাতিজার কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবত।

আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবত মঙ্গলবার যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি কারও সমালোচনা করতে চাই না; কারও বিরুদ্ধাচরণ করতে চাই না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও কষ্টে বলতে হয় কিছু কথা। (মনোনয়নের পর) ৪০ দিন কেটে গেছে, আমি সত্যিকার অর্থে অনেকের সহযোগিতা পাইনি।’

সিলেটে দলের মনোনীত প্রবাসী মেয়রপ্রার্থী নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। এখানে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। রাজশাহীতে দলীয় প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে নেই মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। লিটনের পক্ষে নির্বাচনি গণসংযোগ করার কারণে সংগঠনের কয়েকটি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। দলীয় একজন সংসদ-সদস্য এ কাজটি করেছেন। এ দুই সিটিতে দলের সব নেতাকর্মীকে ভোটের মাঠে নামানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।

এর বাইরেও দেশের অধিকাংশ জেলা-মহানগর, উপজেলা-পৌর শাখা, এমনকি আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন কমিটির নেতারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছেন। এসব স্থানে বিএনপি, জামায়াত বা জাতীয় পার্টি যতটা না তাদের প্রতিপক্ষ, এর চেয়ে বেশি নিজ দলের নেতাকর্মীরা চিহ্নিত হচ্ছেন শত্রু হিসাবে। এ নিয়ে হামলা, মামলা, সংঘর্ষ ও খুনোখুনি অতি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের জনবহুল এলাকা উদয়ন মোড়ে ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় জেলা যুবলীগের সাবেক শ্রমবিষয়ক সহসম্পাদক ও শিবগঞ্জ পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর খাইরুল আলম জেম নিহত হন। অভিযোগ উঠেছে, তাকে নিজ দলের কর্মীরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা কৃষক লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মেসবাউল হক টুটুলসহ কয়েকজন দলীয় কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর ২৫ এপ্রিল রাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার বশিকপুর ইউনিয়নের পোদ্দারবাজারে জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং পূর্বশত্রুতার জেরে প্রতিপক্ষ গ্রুপ এই ডাবল মার্ডার করে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কুমিল্লার তিতাসে ৩০ এপ্রিল রাতে উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেনকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডটিও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে হয়েছে বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করছেন। এ ঘটনায় তিতাস উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিনুল ইসলামসহ দলের কয়েকজন নেতাকর্মীকে আসামি করে নিহত ওই নেতার স্ত্রী পপী আক্তার মামলা করেছেন বলে জানা গেছে।

বরগুনার আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম পনুকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ২ মে রাতে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা মোতাহার মৃধার অনুসারীরা তাকে খুন করেন বলে শফিকুলের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও বরগুনার মতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছেন। আর এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে কাজ করেছে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা, সংগঠনের নেতৃত্বপ্রাপ্তির লড়াই এবং এলাকায় দলীয় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মে মাসে তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ১২৭টি রাজনৈতিক সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনায় ৭ জন নিহত এবং ১ হাজার ৭২৩ জন আহত হয়েছেন। নিহত ৭ জনের মধ্যে ৫ জনই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট ঘটনায় মারা যান। এ সময় ১২৭টি রাজনৈতিক সহিংসতা সংঘটিত হয়, যার মধ্যে ৩৩টি ঘটনায় আওয়ামী লীগের নিজেদের। এতে ৪ জন নিহত এবং ৪৩৪ জন আহত হয়েছেন। আগের বছর (২০২২) সালে ৪৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ৭০ জন নিহত এবং

৬ হাজার ৯১৪ জন আহত হন। নিহত ৭০ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের রয়েছেন সর্বাধিক ২৪ জন। এই ২৪ জনের মধ্যে আবার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সৃষ্ট ৮৮টি সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং ১ হাজার ১৪৪ জন আহত হয়েছেন। এর আগের বছর ২০২১ সালে ৯৩২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ১২৭ জন নিহত ও ১০ হাজার ৮৩৩ জন আহত হন। এর মধ্যে সর্বাধিক ৬৯ জন নিহত হন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। আবার দলটির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সৃষ্ট ৭৩টি সংঘর্ষ ও সহিংসতায় ৯ জন নিহত এবং ১ হাজার ৪৪ জন আহত হন।

গত বছর অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৭ প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। ওই নির্বাচনে প্রতিটি জেলায় আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া ৬১টি জেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন ৪৮ জন। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ২৬ জন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, একটি বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকবে, যেটা অস্বাভাবিক নয়। তবে দলের মধ্যে কিছু আদর্শবিরোধী লোক ঢুকে পড়েছে, তারা হানাহানি করছে। তাদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সতর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, আমরা দলীয় কোন্দল নিরসনে কাজ করছি। সংসদ নির্বাচনের আগে দলের মধ্যে যে কোনো বিরোধ বা মনোমালিন্য দূর করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেছেন, নির্বাচনি মাঠে দৃশ্যমান শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায় কিছু কিছু স্থানে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অরাজনৈতিক আচরণ করছেন। কেন্দ্র থেকে তীক্ষ্ণ নজরদারি রয়েছে, যেন দলে অভ্যন্তরীণ এ প্রতিযোগিতা সহিংসতার কারণ না হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম