ভান্ডারিয়ায় মৃতরাও ভোটার তালিকায়!
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মৃত ব্যক্তিদের রেখেই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার অভিযোগ উঠেছে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া পৌরসভায়। ওই তালিকায় পাঁচ-ছয় বছর আগের অর্থাৎ ২০১৭ ও ২০১৮ সালের মৃতরাও রয়েছেন। সম্প্রতি ভোটার পুনর্বিন্যাসেও রাখা হয়েছে তাদের। শুধু তাই নয়, এক ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের অন্য ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় দেখানো হয়েছে। যার সংখ্যা হাজার খানেক। এসব অনিয়ম রেখেই চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়।
জানা যায়, ২০২২ সালের ২০ মে থেকে ২০ নভেম্বর দেশজুড়ে চার ধাপে ভোটারযোগ্য ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ চলে। নির্বাচন কমিশন থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের মধ্য দিয়ে তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচি শুরু করা হয় তখন। এতে যোগ্য ব্যক্তিদের ভোটার করার পাশাপাশি ভোটার তালিকা থেকে মৃত ব্যক্তিদের নাম বাদ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সেখানে হালনাগাদে যেমন মৃতদের ভোটার রাখা হয়েছে, তেমনই ভোটার পুনর্বিন্যাসেও তাদের রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে ২২ মে বিকালেই অনিয়ম ও ভুলভ্রান্তি সংশোধনের আবেদন করেছেন অনেক ভুক্তভোগী।
ওইদিনই উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়, প্রধান নির্বাচন কমিশন কার্যালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব বরাবর এসব ভুলভ্রান্তি উল্লেখ করে এলাকাবাসীর পক্ষে তা সংশোধন করার আবেদন করেন মালিক মো. সওকত ইকবাল নামের একজন স্থানীয় ভোটার। লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ আবেদনকারীদের।
উলটো যারা অভিযোগ করেছেন, তারা যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেননি বলে তাদের নামে চিঠি পাঠিয়েছে উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়। যদিও আইন অনুযায়ী, তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার দায়িত্ব নিজ নিজ নির্বাচন কার্যালয়ের। স্থানীয় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, আগের হালনাগাদ ভোটার তালিকা ঠিকমতো করা হলে এ সমস্যা তৈরি হতো না। সামনে আবারও হালনাগাদ করা হবে। সেখানে এই জটিলতা থাকবে না।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। স্থানীয় ভোটাররা যদি ভোটার তালিকা নিয়ে কোনো অভিযোগ করেন, তাহলে নির্বাচন কমিশনের উচিত নিজ উদ্যোগ ও খরচে তা বিচারবিশ্লেষণ করে খোঁজখবর নেওয়া। তথ্যপ্রমাণ ও দলিল দেওয়া জনগণের দায়িত্ব নয়। প্রয়োজনে ভোটার তালিকা পুনরায় হালনাগাদ করতে হবে। নতুন সংশোধিত ভোটার তালিকা না করা পর্যন্ত কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
স্থানীয়রা জানান, ১৫ মে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে ভান্ডারিয়া পৌরসভা নির্বাচনের জন্য পুনর্বিন্যাস করা সীমানা অনুযায়ী ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার জন্য লিখিত নির্দেশনা জারি করা হয়। মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে নতুন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার জন্য একজন কর্মকর্তাকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়ারও নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। সে নির্দেশনা অনুযায়ী মাত্র চার কার্যদিবস পরই ২২ মে নতুন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে তা প্রকাশ করে ভান্ডারিয়া উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়।
হালনাগাদ করা ভোটার তালিকায় কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তা ২৩ ও ২৪ মে অফিস চলাকালীন ভোটার তালিকা পুনর্বিন্যাসকারী কর্মকর্তা বরাবর লিখিতভাবে জানানোর অনুরোধ করা হয়। হালনাগাদকৃত প্রকাশ করা ভোটার তালিকায় দেখা যায়, পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডে প্রায় ২০০ ভোটারের নাম রয়েছে, যারা অনেক আগেই মারা গেছেন। যাদের অনেকেরই ডেথ সার্টিফিকেট এই প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে। এমন অনেকের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা অন্য এলাকার। চাকরি সুবাদে একসময় ভান্ডারিয়া পৌরসভায় থাকলেও ৫ বছর ধরে তারা বদলি হয়ে অন্য জেলা বা বিভাগে চলে গেছেন। কিন্তু তাদের নামও হালনাগাদ করা ভোটার তালিকায় রয়েছে। এছাড়া সবচেয়ে বেশি ভুল রয়েছে ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকায়। এমন অনেক ভোটার রয়েছেন, যাদের নিজ ওয়ার্ডের পরিবর্তে অন্য ওয়ার্ডের ভোটার দেখিয়ে তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। শুধু ১ নম্বর ওয়ার্ডেই এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। সব মিলিয়ে দুশরও বেশি ভোটারকে এভাবে অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে।
এছাড়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৮শ ভোটার রয়েছেন, যারা ২০২১ সালের ২১ জুনের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পাশের শিয়ালকাঠি ইউনিয়নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। তাদেরও নতুন হালনাগাদ হওয়া তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নতুন ভোটার তালিকা অনুযায়ী এই ৮ শতাধিক ভোটার ইউনিয়ন পরিষদে ভোট দিয়েছে, এখন পৌরসভায় পুনরায় ভোট দেবে। এছাড়া প্রায় ২০ হাজার ভোটারের এ তালিকায় অনেকে আছেন যারা ভান্ডারিয়া পৌরসভায় বসবাসই করেন না। হয়তো আশপাশের উপজেলার বাসিন্দা।
ভুক্তভোগী ভোটাররা বলছেন, মূলত মাত্র ৪ দিনের মধ্যে পুরো পৌরসভার ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে যাওয়াতেই এ ভুলভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনি কর্মকর্তারা কারও ঘরবাড়িতে না গিয়েই আগের তালিকাকে হালনাগাদ হিসাবে প্রকাশ করেছেন। ভুলভ্রান্তিতে ভরা এ হালনাগাদ করা ভোটার তালিকা সংশোধন না করে আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন আয়োজন করলে তাতে সমস্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন ভান্ডারিয়া পৌরবাসী।
প্রকাশ করা ভোটার তালিকায় দেখা যায়, পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডে প্রায় দুইশ ভোটারের নাম রয়েছে, যারা অনেক আগেই মারা গেছেন। ডেথ সার্টিফিকেটে দেখা যায়, ভোটার নং ৭৯০৫১২০০০১০০ ইলিয়াস খান, পিতা-আসমত আলী খান ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মারা গেছেন। ভোটার নং ৭৯০৫১৬৮১৪৭৭৯, আব্দুল খালেক, পিতা-গফুর ২০১৮ সালের ২৮ আগস্ট মারা গেছেন। একইভাবে ভোটার তালিকায় দেলোয়ার হোসেন, আব্দুল আজিজ সিকদার, আবুল হাশেম হাওলাদার, আব্দুল খালেক বেপারী, আব্দুর রব হাওলাদার, গাজী আফজাল হোসেন, মহব্বত আলী হাওলাদারসহ আরও অনেক মৃত ভোটার রয়েছে হালনাগাদ ভোটার তালিকায়।
ভান্ডারিয়া উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন বলেন, ভোটার তালিকায় যদি মৃতদের নাম থাকে, সেটা হালনাগাদ থেকেই বাদ দেওয়ার কথা। সেটা যদি না হয়ে থাকে, তাহলে তার কিছু করার নেই। এখন তারা সীমানা অনুযায়ী ভোটার পুনর্বিন্যাস করেছেন। সেখানেও যদি কোনো মৃত ভোটার থাকে, তাহলে তাকে বাদ দেওয়া যাবে। কিন্তু অভিযোগকারীরা তথ্যপ্রমাণসহ কিছু দিতে পারেনি বলে সেটা সম্ভব হয়নি।