বাতিঘর প্রকল্পে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন
অচলাবস্থার নেপথ্যে ডিজি পিডি ও ঠিকাদার
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের উপকূলে বাতিঘর স্থাপন সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, জটিলতা ও অচলাবস্থার জন্য তিন পক্ষকে দায়ী করেছে নৌ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি।
এর মধ্যে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। সম্প্রতি গোপনে ওই কমিটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
এতে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মো. নিজামুল হকের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক সাব-কন্ট্রাকটর নিয়োগ, ভয়ভীতি দেখানো, বেআইনিভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়াকরণসহ সাতটি অভিযোগের প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের বিরুদ্ধে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয়ের ঘাটতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কয়েকটি অভিযোগ যাচাইয়ে ‘কারিগরি কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। আর প্রধান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোরিয়ার সামহি কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
এর মধ্যে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ না দেওয়া, সংস্থা প্রধান, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব, যথাসময়ে কাজ না করাসহ আরও কিছু বিষয় আছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনে কয়েকটি কাজের বিল সঠিক প্রক্রিয়ায় দেওয়াসহ কাজের মান ঠিক আছে কি না-তা যাচাইয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। ওই কমিটি এসব ঘটনায় প্রকল্পের কোন কোন কর্মকর্তা দায়ী তা নির্ধারণ করবে।
এতে প্রকল্পের কয়েকটি বিষয়ে ‘অধিকতর’ যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-ভোলার চর কুকরি-মুকরিতে বালুর পরিবর্তে কাদামাটি দিয়ে ভূমি উন্নয়ন করার পরও মহাপরিচালকের অনুমোদন ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সর্বশেষ ৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিল পরিশোধ। আইসিটি ইকুইপমেন্ট মোবিলাইজেশনের কাজ শেষ করার আগেই এ খাতের টাকা খরচ করা হয়। এছাড়া চর কুকরি-মুকরি, দুবলার চলে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজের বিল পাসের তৎপরতাও এর ভেতর আছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব ঘটনায় কমোডর মো. নিজামুল হককে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে নৌ মন্ত্রণালয়। তবে প্রকল্পের পরিচালক, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সরাসরি কোনো সুপারিশ করা হয়নি। তাদের বিষয়ে কারিগরি কমিটির মাধ্যমে দায়-দায়িত্ব যাচাইয়ের পর ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে মোট আটটি সুপারিশ করা হয়েছে।
‘‘এস্টাবিলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগেটেড নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’’ শীর্ষক এ প্রকল্পের অনিয়ম, জটিলতা ও অচলাবস্থা চিহ্নিত করতে কমিটি গঠন করা হয়।
গত ২৬ এপ্রিল নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার বণিকের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি কাজ করে। অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে সম্প্রতি কমিটি নৌসচিব মো. মোস্তফা কামালের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ৪২২ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনে ২২ জনের বক্তব্য নেওয়া হয়। এটি বাতিঘর প্রকল্প হিসাবে বেশি পরিচিত। প্রকল্পটি আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা।
প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রতিমন্ত্রী (খালিদ মাহমুদ চৌধুরী) মহোদয়ের কাছে জমা দিয়েছি। তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর বেশি কিছু আর বলতে চাই না। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ এসেছে তা শতভাগ বাস্তবায়ন করা হবে। কারও যদি সামান্যতম অনিয়ম ও দায় থাকে তাকেও ছাড় দেওয়া হবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য বলেন, তদন্ত পরিচালনা করতে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি। বিভিন্ন জনের অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যে প্রকল্পের উপ ও সহকারী পরিচালকদের বিরুদ্ধে কাজ না করে বিল দেওয়ার নামে টাকা ভাগাভাগির তথ্য উঠে এসেছে।
এমনকি নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কমোডর আবু জাফর মো. জালাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কোনো কাজে প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কে কত টাকা দিয়েছেন তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। টাকা লেনদেনের ওই বক্তব্য বৈঠকের কার্যবিবরণীতেও উঠে এসেছে। তবুও প্রকল্পের এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, প্রতিবেদনে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মো. নিজামুল হকের বিরুদ্ধে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামহি কনস্ট্রাকশন যেসব অভিযোগ এনেছে সেগুলোর সাতটির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা এবং সমাপ্ত কাজ ভেঙে ফেলার জন্য ব্যয়িত অতিরিক্ত অর্থ মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত দায় হিসাবে গণ্য করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমোডর মো. নিজামুল হক যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তে আমি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন এবং প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দিতে পৃথক দুটি প্রস্তাব করেছিলাম। এজন্য সুনির্দিষ্ট অনেক কারণও উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু তা না করে নৌ মন্ত্রণালয় নিজেরা একটি কমিটি গঠন করেছে। সেখানে অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাউকে রাখা হয়নি। প্রকল্প পরিচালককেও বহাল রেখেছে। আর আমি প্রতিবেদন পাইনি। সুতরাং এ প্রতিবেদনের বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
অপরদিকে প্রকল্প পরিচালক ক্যাপ্টেন আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান প্রকল্পের কাজে অচলাবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার অনেকগুলোর সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটি। তবে কয়েকটি বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য পাওয়ায় সেগুলোর বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে অধিকতর যাচাইয়ের সুপারিশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্থা প্রধান, কোরিয়ার কনসালটেন্ট, স্থানীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে প্রকল্প পরিচালকের যথাযথ সমন্বয়ের অভাবে এ ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত বিল প্রদানের অভিযোগ, কাজ না করে বিল প্রদান, মালামাল সংগ্রহে অনিয়ম এবং ইতোপূর্বে সম্পাদিত কাজের অনিয়ম যাচাই কারিগরি কমিটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করা যেতে পারে।