বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন
প্রথম ধাপে ৬৪ জেলায় শোডাউনের সিদ্ধান্ত
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত: ২০ মে থেকে নতুন কর্মসূচি শুরু * চূড়ান্ত ধাপে থাকতে পারে ঢাকা ঘেরাও, ঢাকামুখী রোডমার্চ, ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি * ঐকমত্য না হওয়ায় আটকে গেছে যৌথ রূপরেখার ঘোষণা
হাবিবুর রহমান খান
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে নতুন কর্মসূচি নিয়ে ২০ মে থেকে ফের রাজপথে নামছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। জেলা সমাবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে প্রথম ধাপের কর্মসূচি।
৬৪ জেলাতেই সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। মঙ্গলবার স্থায়ী কমিটি ও বুধবার সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এ কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হয়। চার পর্বে প্রতি শনিবার এ কর্মসূচি পালন করা হবে। পরশু ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে এর ঘোষণা আসবে। দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচির খসড়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ঈদুল আজহার পর চূড়ান্ত ধাপে ঢাকা অভিমুখে কর্মসূচির পক্ষে মত দেন নেতারা। সেক্ষেত্রে ঢাকা ঘেরাও, ঢাকামুখী রোডমার্চ, ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে বলে জানান তারা।
সমমনা দলসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে নতুন কর্মসূচি হিসাবে ঢাকা থেকে বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চের প্রস্তাব দিলেও তাতে আগ্রহ দেখায়নি দলটির নীতিনির্ধারকরা। এ কর্মসূচি নির্বিঘ্নে করা যাবে কিনা-তা নিয়ে সংশয় থাকায় আপাতত না করার পক্ষে মত দেন তারা।
এর পরিবর্তে বড় জেলায় সমাবেশ করার পক্ষে সবাই পরামর্শ দেন। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়েই সরকারের ওপর প্রবল চাপ তৈরির পক্ষে নীতিনির্ধারকরা। তাই আপাতত হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতেও যেতে চায় না দলটি।
এদিকে সরকারের পতন ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের ঘোষিত দফা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারায় বিলম্ব হবে যৌথ রূপরেখার ঘোষণা। এ নিয়ে সমঝোতায় গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ফের আলোচনায় বসতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে ‘অলআউট’ মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। আন্দোলনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করে দলটি। কর্মসূচিসহ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে তাদের মতামত নেওয়া হয়।
একই লক্ষ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদেরও মতামত নেয় হাইকমান্ড। কর্মসূচির পাশাপাশি যৌথ রূপরেখা চূড়ান্তেও গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। এসব বৈঠকের একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নতুন কর্মসূচি ও যৌথ রূপরেখার দফা নিয়ে তৈরি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এসব প্রস্তাব নিয়ে নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরেন।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, নানা কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনের গতি কিছুটা মন্থর হয়ে পড়েছে। বিগত বিভাগীয় গণসমাবেশের পর নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা চাঙা ভাব তৈরি হয়।
রাজপথের আন্দোলনে তারা বেশ উজ্জীবিত ছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিএনপির আন্দোলন নিয়ে তৈরি হয় একটা ইতিবাচক ধারণা। এবার একটা কিছু হবে সবার মধ্যে একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়।
কিন্তু আন্দোলনের সেই গতিতে কিছুটা ছন্দপতন হচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। তাই নেতাকর্মী ও সমর্থকদের পুনরায় উদ্দীপ্ত করা উচিত। সে লক্ষ্যে ১২ অক্টোবর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভাগীয় গণসমাবেশের আদলে কর্মসূচি দেওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে কয়েক নেতা পরামর্শ দেন।
তারা বলেন, জেলায় সমাবেশের মাধ্যমে ব্যাপক শোডাউন করা যেতে পারে। যাতে করে সরকারের টনক নড়ে। ঈদুল আজহা পর্যন্ত এই কর্মসূচি টেনে নেওয়া যায়। এ প্রস্তাবের পক্ষে বেশিরভাগ সদস্যই মত দেন। জেলা সমাবেশের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহরে রোডমার্চের পক্ষে অনেকের মত থাকলেও স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা বলেন, এসব কর্মসূচির গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু তা নির্বিঘ্নে পালন করা যাবে কিনা তা ভাবতে হবে।
ঢাকা থেকে বিভাগীয় শহরে রোডমার্চ শুরু করলে সরকার তাতে সহযোগিতা করবে-এটা ভাবা ঠিক নয়। কর্মসূচি যাতে সফল না হয় সে লক্ষ্যে মামলা-হামলাসহ নানাভাবে বাধা দেবে সরকার।
চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে সেটা একটা বড় ধাক্কা হবে। তাই আগেভাগে শক্তি ক্ষয় না করে কুরবানির ঈদের পর রাজধানীকেন্দ্রিক কর্মসূচির দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে ঢাকা ঘেরাও, ঢাকামুখী রোডমার্চ, ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচি হতে পারে।
তাতে বাধা দিলে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতেও যাওয়া যাবে। তবে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিনক্ষণ নিয়ে নীতিনির্ধারকরা নানা হিসাব করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন ছাড়াও যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণঅধিকার পরিষদের বেরিয়ে যাওয়া, জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী পালনসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র হিসাবে রাষ্ট্র মেরামতে গণতন্ত্র মঞ্চের দেওয়া ৩৫ দফা ও সরকার পতনের ১৪ দফা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে সরকার পতনে ১০ দফা ও রাষ্ট্র মেরামতে ২৭ দফা ঘোষণা করেছে।
দলটি ১০ দফার ভিত্তিতে পরিচালিত যুগপৎ আন্দোলন সফল করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে চায়।
২৭ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সারা দেশের বিভাগীয় পর্যায়ে সেমিনারে এবং পুস্তিকা আকারে ঢাকার বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে বিতরণ করে দলটি।
বিএনপি নেতাদের দাবি, ১০ দফা দাবি ও ২৭ দফা রূপরেখা মানুষ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। সুতরাং ২৭ দফা থেকে সরে যাওয়া উচিত হবে না বলে বৈঠকে উপস্থিত সব নেতাই মত দেন।
তারা বলেন, প্রয়োজনবোধে মিত্রদের অন্য দাবিগুলো ২৭ দফা রূপরেখায় উপদফা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। পরে মিত্রদের সঙ্গে পুনরায় এ নিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়।
ফলে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র ঘোষণা আপাতত হচ্ছে না। বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে গণঅধিকার পরিষদের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। এর পেছনে সরকারের ইন্ধন রয়েছে বলে শরিকরা সন্দেহ করলেও বিএনপির নীতিনির্র্ধারকরা সে রকম ভাবছেন না।
তারা বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের মনোমালিন্যের কারণে এটি হয়েছে। এর পেছনে বিএনপির কোনো ভূমিকা নেই। কারণ গণতন্ত্র মঞ্চ একটি আলাদা জোট। তবে জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও যুগপৎ আন্দোলনে থাকবে গণঅধিকার পরিষদ।
এদিকে স্থায়ী কমিটির পর কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে বুধবার রাতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে স্থায়ী কমিটিতে ১৯ জেলায় সমাবেশ করার নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা তুলে ধরে সবার মত চাওয়া হয়।
এক্ষেত্রে বেশিরভাগ নেতাই সব জেলায় সমাবেশ করার পক্ষে মত দেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে ৬৪ জেলাতেই কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। শনিবার ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গায়েবি মামলা ও পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে শনিবার ঢাকায় সমাবেশ : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবি আদায় এবং গায়েবি মামলায় নির্বিচারে গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা ও পুলিশি হয়রানির প্রতিবাদে আগামীকাল সমাবেশ করবে বিএনপি।
দুপুর ২টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হবে। বুধবার রাতে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ঢাকাবাসীসহ বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে যথাসময়ে সমাবেশে যোগ দিয়ে তা সফল করার আহ্বান জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন-ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম, সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, সদস্য সচিব আমিনুল হক, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল প্রমুখ।