মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ
নোবেলকে গ্রেফতারে নারকোটিক্সে বৈঠক
তোহুর আহমদ
প্রকাশ: ১০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তরুণ সংগীতশিল্পী মইনুল আহসান নোবেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (নারকোটিক্স)। সোমবার অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়।
এতে অবিলম্বে নোবেলকে আইনের আওতায় আনার পক্ষে মতামত দেন বেশিরভাগ কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, নোবেলসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মাদকসংক্রান্ত যেসব তথ্যপ্রমাণ আছে তা সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হবে। ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পেলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ভারতীয় চ্যানেল জি-বাংলার ‘সারেগামাপা’খ্যাত সংগীতশিল্পী নোবেলের বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ এখন তুঙ্গে। অনেকটা আত্মস্বীকৃত মাদকসেবী তিনি। সর্বশেষ ২ সপ্তাহ আগে কুড়িগ্রামে একটি কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়েন নোবেল। এতে বিরক্ত দর্শকরা তার দিকে জুতা পর্যন্ত ছুড়ে মারেন। শেষমেশ অনুষ্ঠান অসমাপ্ত রেখেই তাকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় আয়োজক কমিটি।
তবে নারকোটিক্স বলছে, মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বেশ কয়েক মাস ধরেই নোবেল তাদের নজরদারিতে আছেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তার ফোনালাপের বেশকিছু অডিও উদ্ধার করা হয়। এসব ফোন রেকর্ডে তার মাদক সেবনের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। এমনকি নোবেল সরাসরি মাদকের অর্ডার দিচ্ছেন এমন একাধিক অডিও রেকর্ড পায় নারকোটিক্স। এছাড়া তার মাদক সেবনের একাধিক ভিডিও চিত্রের বেশকিছু স্ক্রিনশট আছে নারকোটিক্সের হাতে।
তবে মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রসঙ্গে নোবেলের কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি যুগান্তর। এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য তার দুটি ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। পরে এ বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে তার ফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু এতেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
নারকোটিক্স কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যক্তিগতভাবে নোবেলের মাদক সেবন বা নৈতিকস্খলন নিয়ে নারকোটিক্সের তেমন কিছু বলার নেই। কিন্তু গায়ক হিসাবে তিনি তরুণ প্রজন্মের ক্রেজ। অনেকের কাছে রীতিমতো আইকন। তারা অনুকরণ করেন তাকে। ফলে নোবেলের মাদকসংশ্লিষ্টতায় সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। কেননা, তার মতো তরুণদের অনেকে না বুঝেই মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
সূত্র বলছে, এমন বাস্তবতায় নোবেলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে নারকোটিক্স। তাকে গ্রেফতার বা ডোপ টেস্টের আওতায় আনতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি অংশ এ বিষয়ে আরও উচ্চপর্যায় থেকে বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে।
এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সেলিব্রেটি হলেও নোবেলকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে এ নিয়ে ভবিষ্যতে যাতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ ইতঃপূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চিত্রনায়িকা পরীমনি বা মাহিয়া মাহিকে গ্রেফতারের পর সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সমাজিকভাবে ট্রলের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশি (ডিবি) বিতর্ক এড়াতে পারেনি। তাই নোবেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, মাদকসংশ্লিষ্টতায় বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান নারকোটিক্সের নজরদারিতে আছেন। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতার সাবেক স্ত্রী, গুলশানের একটি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউজের মালিকের ছেলে আহাম্মেদ সাদমান, নামকরা ব্যান্ড সংগীতশিল্পীর বখাটে ছেলে, জাতীয় পর্যায়ে এক শীর্ষ নারী খেলোয়াড়ের ছেলে তারেক এবং একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জনৈক আমানের বিরুদ্ধে মাদকসংশ্লিষ্টতার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। এছাড়া আইসসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে একজন অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তার মেয়ে প্রিয়াংকা মতিনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে নারকোটিক্স।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রিয়াংকা মতিনের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে নজরদারি চালানো হয়। এতে তার মাদকসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ মেলে। প্রায় প্রতি রাতেই তার ফ্ল্যাটে ‘হানি ট্রিপ’ নামে বিশেষ আইস পার্টির আয়োজন করা হয়। সেখানে নানা অনৈতিক কার্যকলাপের পাশাপাশি দেদার মাদক সেবনের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে নারকোটিক্সের হাতে।
মোনা-ডোনা : আইসসংশ্লিষ্টতায় নজরদারিতে আছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী মোনা এবং ডোনা। গুলশান-বনানী এলাকার অভিজাত পার্টিতে তারা নিয়মিত অতিথি। মাদক সেবনের পাশাপাশি তারা ‘উইড’ বা ‘পড’ নামের এক ধরনের সিনথেটিক গাঁজার ‘হোম ডেলিভারি’ দেন।
নারকোটিক্সের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী মোনার আসল নাম মেহনাজ। বিভিন্ন জায়গায় তিনি নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দেন। এছাড়া ডোনার সঙ্গে এসআই (উপ-পরিদর্শক) মনির হোসেন নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার বন্ধুত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। পুরান ঢাকার ধলপুর থেকে রাত ৯টার পর রাজধানীর গুলশানে হাজির হন তারা। এছাড়া মাদকসংশ্লিষ্টতায় নারকোটিক্সের নজরদারিতে আছেন ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান গুলশানের বাসিন্দা জনৈক জাবের খান ও গোয়েন্দা পুলিশের কথিত সোর্স শহিদুল ইসলাম ওরফে ডিবি শহিদুল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) ডিআইজি তানভীর মমতাজ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘গায়ক নোবেলসহ মাদকসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে এমন বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটি নারকোটিক্সের নজরদারিতে আছে। তাদের সম্পর্কে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।