কোন্দল নিয়ে দুশ্চিন্তা ক্ষমতাসীনদের
সবার নজর পাঁচ সিটির ভোটে
সিটি নির্বাচন: কাউন্সিলর পদে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ‘শিথিল’ বিএনপির
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশনে ভোটের আয়োজন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে তিন সিটিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধে ক্ষতবিক্ষত ক্ষমতাসীন দলটি অনেকটাই বিদ্রোহের দাবানলে পুড়ছে। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন নয়-এই স্লোগান দিয়ে সিটির ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। কিন্তু কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কাউন্সিলর পদে ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেছেন দলটির তৃণমূলের অনেক নেতাই। মাঠ পর্যায়ের ওপর কেন্দ্রের এই শিথিলতা বিএনপিকে অনেকটাই অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এছাড়া মেয়র পদে প্রার্থী না থাকলেও কাউন্সিলর পদে ভোট করছে জামায়াতে ইসলামীরও বেশ কয়েকজন মাঠের নেতা। এর বাইরে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে অংশ নিচ্ছে এই নির্বাচনে। ইতোমধ্যে দুই দলই তাদের মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামও ঘোষণা করেছে। তবে কে অংশ নিল আর কে নিল না-তা ছাপিয়ে সাধারণ ভোটাররা নির্বাচন কমিশন, মাঠ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা দেখতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক দল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের মতে, সিটি নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনের আচরণ, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, ভোটারদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতিসহ নানা ঘটনার ওপর নজর থাকবে সবার। বন্ধুপ্রতিম দেশ ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদেরও দৃষ্টি থাকবে এই নির্বাচনের ওপর। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে পাঁচ বিভাগীয় শহরে ভোটের এই আয়োজন চাপ ও প্রভাবমুক্ত থেকে কতটা নির্বিঘ্নে এবং দক্ষ হাতে সম্পন্ন করতে পারে নির্বাচন কমিশন-তা দেখার অপেক্ষায় আছেন অনেকেই। সাধারণ ভোটারদের উপস্থিতি কেমন হয়, তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কিনা-এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে নির্বাচনে। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে সিটি ভোটের ওপর সবার রয়েছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেনি আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন এলাকায় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের ভোটের মাঠ থেকে হটাতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জোরজবরদস্তি করেছে। তাই আমরা এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কী হয়-তা দেখার অপেক্ষায় আছি। তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচন সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। সরকারি দল এবং মাঠ প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আচরণ কী হয়-তা দেখার বিষয়। আরও বড় বিষয় হচ্ছে, চাপ ও প্রভাবমুক্ত থেকে নির্বাচন কমিশন কতটা দক্ষতার সঙ্গে এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে এই নির্বাচন আয়োজন করতে পারে-তাও দেখার বিষয়। মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কি না, মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে কি না-এসব দেখে আমরা জাতীয় নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। কারণ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে, তা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেখে বোঝা যাবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন শব্দ হচ্ছে বেছে নেওয়া। আপনি চা, কফি না শরবত খাবেন-এটা যেমন বেছে নেওয়ার অধিকার আছে। তেমনি নির্বাচনেও পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার অধিকার ভোটারের থাকতে হবে, ক্ষমতা থাকতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প ও সমান অধিকার এবং সুযোগ থাকতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা আমাদের ভোটারদের আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে অতীতের মতো এবারও একতরফা ভোট হবে। মানুষের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না।
সম্প্রতি ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলবে। সব সিটি নির্বাচনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন। ওইদিন নির্বাচন কমিশনের সভা থেকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সিটি নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ করা হবে এবং প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। ভোটগ্রহণের হালনাগাদ তথ্য কর্মকর্তারা ট্যাবের মাধ্যমে কমিশনকে জানাবে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণার পর গত ১৫ এপ্রিল পাঁচ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করে আওয়ামী লীগ। খুলনা সিটি করপোরেশনের জন্য তালুকদার আবদুল খালেক, সিলেট সিটি করপোরেশনের জন্য মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের জন্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, বরিশাল সিটি করপোরেশনের জন্য আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত এবং গাজীপুরে সিটি করপোরেশনের জন্য অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খানকে মেয়র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর মধ্যে বরিশাল এবং গাজীপুরে প্রার্থী বদল করে ক্ষমতাসীনরা, আর সিলেটে দেওয়া হয় নতুন মুখ। দুই সিটিতে প্রার্থী বদল এবং এক সিটিতে নতুন মুখ-অভ্যন্তরীণ সংকটে ফেলে দিয়েছে ক্ষমতাসীনদের। তিন সিটিতেই দলীয় বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
আওয়ামী লীগের পরপরই পাঁচ সিটিতে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খ চরমোনাইকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এছাড়া গাজীপুরে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, খুলনায় দলের নায়েবে আমির হাফেজ মাওলানা আবদুল আউয়াল, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হাফেজ মাওলানা মাহমুদুল হাসান এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজশাহী মহানগর সহসভাপতি হাফেজ মাওলানা মুরশিদ আলম ফারুকীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বরিশালে মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে ইসলামী আন্দোলনে। ফলে তারাও এখানে অভ্যন্তরীণ সংকটে ভুগছে।
বৃহস্পতিবার পাঁচ সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সাবেক সচিব এমএম নিয়াজউদ্দিন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনে মো. সাইফুল ইসলাম স্বপন, খুলনা সিটি করপোরেশনে মো. শফিকুল ইসলাম মধু, বরিশাল সিটি করপোরেশনে প্রকৌশলী মো. ইকবাল হোসেন তাপস এবং সিলেট সিটি করপোরেশনে মো. নজরুল ইসলাম বাবু লাঙ্গল নিয়ে ভোটের মাঠে লড়বেন।
রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী আন্দোলন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেও নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত বাকি দলগুলো এই ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটে থাকা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি-জেপি, তরিকত ফেডারেশনসহ অন্যরা ভোটের পক্ষে থাকলেও তারা কার্যত নীরব। বিএনপিসহ তাদের সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপদ আন্দোলনে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিটি, কল্যাণ পার্টিসহ নিবন্ধিত দলগুলোর বড় অংশই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আলাদা জোট করে পথচলা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদসহ বাম প্রগতিশীল ঘরানার দলগুলোও বর্জন করেছে এই নির্বাচন।
মাঠের বিরোধী দল বিএনপি পরিষ্কার করে বলেছে, তারা এই নির্বাচনে অংশ নেবে না। জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি-এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেব না। এটা আমাদের পরিষ্কার অবস্থান। মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী না থাকলেও পাঁচ সিটিতে দলটির মাঠ পর্যায়ের অনেকেই কাউন্সিলর পদে ভোট করছেন-এটা কি তৃণমূলের ওপর কেন্দ্রের এক ধরনের শিথিলতা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত আমরা জানিয়ে দিয়েছি। এই সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার বলেন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনই বলেন-কোনো নির্বাচনেই অংশ নেব না। যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করেন, তাদের চিহ্নিত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।