Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

টাঙ্গাইলে বেপরোয়া পরিবহণ চাঁদাবাজি

বড় মনির দাপটে মালিকরা অসহায়

Icon

মাহবুব আলম লাবলু, টাঙ্গাইল থেকে ফিরে

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বড় মনির দাপটে মালিকরা অসহায়

ফাইল ছবি

টাঙ্গাইলে বেপরোয়া পরিবহণ চাঁদাবাজি চলছে ‘বড় মনির স্টাইলে’। ১০০ টাকার নোটের আদলে ‘আমানত কুপন’ ছাপিয়ে বছরে চাঁদা তোলা হচ্ছে প্রায় দুই কোটি টাকা। বছর শেষে এই টাকা মালিকদের ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে না।

আবার বছরে একদিন পিকনিকের নামে ‘আনন্দভ্রমণ তহবিল’ কুপন ছাপিয়ে সারা বছর প্রতি বাস থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই তহবিলে বছরে আদায় হচ্ছে প্রায় কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বছরে মোট চাঁদা উঠছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এই টাকা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলসহ বিভিন্ন খাতে ভাগবাটোয়ারা হয়। আসন্ন ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছাপানো হয়েছে নজরকাড়া একাধিক কুপন।

অভিযোগ আছে, জেলা মালিক সমিতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসাবে চাঁদার টাকার একটি বড় অঙ্ক লোপাট করছেন পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির মহাসচিব গোলাম কিবরিয়া বড় মনি। তার দাপটে অসহায় মালিকরা এতদিন মুখ বন্ধ করে সব সহ্য করেছেন। কিন্তু কিশোরী ধর্ষণকাণ্ডে আসামি হয়ে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই নেতার স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে মুখ খুলছে এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ। তারই ধারাবাহিকতায় সামনে এসেছে বড় মনির পরিবহণ চাঁদাবাজি কব্জা করার তথ্য। রবি ও সোমবার টাঙ্গাইল সদর, গোপালপুর ও ভূঞাপুর এলাকা সরেজমিন অনুসন্ধান ও সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

স্থানীয় পরিবহণের সঙ্গে জড়িতরা জানান, সারা দেশের পরিবহণ চাঁদাবাজির খবর নতুন কিছু নয়। তবে টাঙ্গাইলে চাঁদাবাজির ধরন একটু আলাদা। সেখানে চাঁদাবাজি নির্বিঘ্ন করতে চালু করা হয়েছে ‘বড় মনির স্টাইল’। নানা উপলক্ষ্যে কায়দাকানুন করে কখনো হুমকি দিয়ে তোলা হচ্ছে চাঁদা। টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সহসভাপতি কাজী আতিকুর রহমান কায়সার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমি ৩৮ বছর ধরে পরিবহণ ব্যবসা করি। ২২-২৩ বছর সমিতির নেতৃত্ব দিয়েছি।

আমাদের কোনো দলমত ছিল না। সবাই মিলে সততার সঙ্গে মালিক সমিতি ও ব্যবসা চালাতাম। আমরা পিকনিক উপলক্ষ্যে কোনোদিন চাঁদা তুলিনি। এখন পিকনিকের নামে বছরে কোটি টাকা চাঁদা উঠছে। মালিকদের কুপন ছিল। কিন্তু কুপনে চাঁদা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। যারা কুপনের টাকা জমা করতেন তারা বছর শেষে কুপন দেখিয়ে টাকা ফেরত নিতেন। বড় মনি সাহেব কুপনের চাঁদা বাধ্যতামূলক করেছেন। কিন্তু এখান থেকে মালিকরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। পরিবহণ ব্যবসার এত নাজুক অবস্থা কখনো দেখিনি। তিনি আরও বলেন, ৬-৭ বছর আগে বড় মনি সাহেব লোকজন দিয়ে ভাঙচুর চালিয়ে সমিতির দখল নেন। এরপর থেকেই তার দাপটে অসহায় হয়ে পড়েছেন মালিকরা।

বড় মনি সম্পর্কে সমিতির এক শীর্ষ নেতা আলাপকালে বলেন, ‘পরিবহণ তো একটা ছোট বিষয়, কত অভিযোগ আছে ওর (বড় মনি) বিরুদ্ধে। কেউ বলতে চাইলে সেগুলো বলুক। এগুলো তো সহজ অভিযোগ। সে আসলে পরিবহণের লোক নয়। রাজনীতি আর পরিবহণ এক নয়। আমি ছোটবেলা থেকে ছাত্রলীগ করেছি। এখন আওয়ামী লীগ করি। সবাই আমাকে চেনেন। কিন্তু ওরা যারা এখানে আসছে ওরা আওয়ামী লীগের নামে আওয়ামী লীগের ক্ষতি করতে আসছে। তারা সঠিক পদ্ধতিতে সমিতি চালায় না। একেবারেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নেই। পরিবহণ খাতে পরিবহণের লোক থাকা উচিত।’ 

এ ব্যাপারে জানতে গোলাম কিবরিয়া বড় মনির মোবাইল ফোনে কল হলে তিনি রিসিভ করে এ প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়েই বলেন, ‘আমি এখন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে আছি। আপনারা আমাকে নিয়ে লিখেছেন তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমি অন্যায় করলে আমার শাস্তি হবে। কিন্তু উনার বিরুদ্ধে একটা মিথ্যা নিউজ করে কাজটা ঠিক করেননি। উনি (জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি) এটার প্রতিবাদ জানাবেন। পরিবহণ সমিতি দখল ও চাঁদাবাজির বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, ‘আমি সভাপতি সাহেবকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ১০ মিনিট পর আপনাকে কল করছি।’ কিন্তু তিনি আর কল করেননি। এ প্রতিবেদক কল করলেও তিনি ধরেননি। 

সরেজমিন অনুসন্ধানে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাঙ্গাইলে যে পরিবার যখন দাপটে থাকেন সেই পরিবারের সদস্যরা জেলা বাস মালিক সমিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। অবৈধ আয়ের সোনার খনি হিসাবে পরিচিত এই খাতের ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে সবার। নানা কারণে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর উত্থান ঘটে অন্য পরিবারের। এভাবেই চলছে। ৮ বছর আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যাকাণ্ডের পর মাঠ ফাঁকা হয়ে যায়। সে সময় টাঙ্গাইলে ‘ফাঁকা ফিল্ডে’ উত্থান ঘটে জার্মান ফেরত দুই সহোদর ছোট মনিরের ও বড় মনির। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছোট মনির টাঙ্গাইলের-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর জেলার প্রায় সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি দখলে নিয়ে মহাসচিব পদে বসেন বড় মনি।

মালিক সমিতির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতিভুক্ত গাড়ির সংখ্যা ৮৫০টি। এর মধ্যে গড়ে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ বাস চলাচল করে। প্রতিদিন একটি বাস থেকে ৫৫০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ হিসাবে মাসে চাঁদা ওঠে ৮২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বছরে যার অঙ্ক দাঁড়ায় ৯ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এই টাকা সমিতির পরিচালনা ব্যয়, মালিকের আমানত, আনন্দভ্রমণ তহবিল, কাউন্টার মাস্টার ও লাইনম্যানসহ বিভিন্ন খাতে ভাগবাটোয়ারা হয়। টাঙ্গাইল পরিবহণ সমিতির উপজেলা পর্যায়ে শাখা অফিস দেওয়া হয়েছে। সেখানে তোলা চাঁদার ভাগও আসে বড় মনির কাছে। এছাড়া এলেঙ্গা স্পটে উত্তরাঞ্চলে চলাচলকারী প্রতিটি গাড়ি থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে।

সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, করোনার সময়ে গাড়ির তেলের টাকা হয়নি। তারপরও সমিতির চাঁদা বন্ধ ছিল না। এমনকি দেড় বছর ধরে মালিকের আমানতের টাকাও আটকে রেখে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে লাগাচ্ছেন বড় মনি। পিকনিক করার জন্য আগে চাঁদা তোলা হতো না। পিকনিকের ব্যয় জেনারেল ফান্ড থেকে মেটানো হতো। কিন্তু বড় মনি তার স্টাইলে কুপন ছাপিয়ে পিকনিক ফান্ডের জন্য বছরে প্রায় কোটি টাকা চাঁদা তুলছেন।

সরেজমিন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডের প্রান্তিক কাউন্টারের সামনে চাঁদা তোলেন লাইনম্যান রাসেল ও রোস্তম। একদিন রাসেল ডিউটি করলে পরদিন ডিউটি করেন রোস্তম। ঝটিকা মাস্টার কাউন্টারের সামনে চাঁদা তুলে নোমান, সুমন, সুজন ও উজ্জ্বল। এরা সবাই চাঁদাবাজি মামলার আসামি। মাঠপর্যায়ে এদের নিয়ন্ত্রক সুপারভাইজার সেলিম শিকদার। গোপালপুর কাউন্টারে চাঁদা তোলা হয় বাদলের নেতৃত্বে।

বাসচালক শ্যামল বলেন, কাউন্টারে এককালীন ৫৫০ টাকার বাইরেও ঘাটাইলে ২০ টাকা, মধুপুরে ২০ টাকা, পাকুটিয়ায় ১০ টাকা, পোড়াবাড়ীতে ১০ টাকা, হামিদপুরে ১০ টাকা, কালিহাতীতে ১০ টাকা ও এলেঙ্গায় ২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। চাঁদার টাকা কোথায় যায় জানতে চাইলে প্রান্তিক পরিবহণের চালক জহিরুল ইসলাম জানান, চাঁদা মূলত মালিক সমিতির নামে তোলা হলেও বেশিরভাগ নেতা ভাগবাটোয়ারা করে নেন। তবে উনারা টাকা তোলেন, উনারাই ভালো বলতে পারবেন টাকা কোথায় খরচ করেন।

জানতে চাইলে টাঙ্গাইল বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমানত কুপনের টাকা লোপাটের ঘটনা ঠিক নয়। এক বছর পর টাকা ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু এবার টাকা ফেরত দেওয়ার সময়ে পিকনিক হওয়ায় ওই খাতের টাকা পিকনিকে খরচ করা হয়েছে। এখন পিকনিক খাতে যে চাঁদা তোলা হচ্ছে সেটা মালিকদের ফেরত দেওয়া হবে।’ পিকনিকের জন্য আলাদা করে ‘আনন্দভ্রমণ তহবিল’ নামে গাড়িপ্রতি দিনে ৫০ টাকা তোলা হচ্ছে। তাহলে এ খাতে মালিকের আমানতের টাকা খরচ করতে হলো কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আগে তোলা হতো না। ৬-৭ মাস ধরে তোলা হচ্ছে।’ টানা ৭ বছর নির্বাচন ছাড়া বড় মনি কীভাবে মহাসচিব থাকছেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হয় না। সিলেকশনের মাধ্যমে হয়। গণতন্ত্র নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবহণ সমিতিতে পরিবহণের লোক এলে ভালো।’

গোয়েন্দা প্রতিবেদন : এদিকে সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় মনি ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। জার্মানি থেকে এসে অর্থের বিনিময়ে পদ-পদবি নিয়েছেন। পেশিশক্তির বলে বর্তমানে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তার ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য নেই। নেতিবাচক কর্মকাণ্ড হিসাবে টেন্ডারবাজি, মানি লন্ডারিং, বাস-ট্রাক সিন্ডিকেটের চাঁদা আদায়, নিয়োগ বাণিজ্য ও অফিস-আদালতে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ৮ ব্যক্তির সিন্ডিকেটের মধ্যে তিনি অন্যতম।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিদিন পরিবহণ সেক্টর থেকে উত্তোলিত ২-৩ লাখ টাকা চাঁদার সিংহভাগ নিয়ে যায় বড় মনি। এছাড়া জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ সব অফিসের ঠিকাদারি কাজের মূল নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে কোটি কোটি টাকা আয় করেন তিনি। তার ছোট ভাই টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ-সদস্য হওয়ায় তিনি উপজেলা দুটির সব উন্নয়ন কাজের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করেছেন। তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক হিসাবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুকের নাম রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারের কারণে দলীয় সাবেক এমপি আমানুর রহমান রানা গ্রুপের সঙ্গে কোন্দল বিদ্যমান। বড় মনির কর্মকাণ্ডে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হিসাবে টাঙ্গাইল শহরে তিনতলা বাড়ি, জার্মানির দ্বৈত নাগরিক হিসাবে জার্মানিতে তার বাড়ি ও মার্সিডিজ গাড়ি থাকার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া তার বিএমডব্লিউ গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা, ঢাকার গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট, তিনটি জিপ গাড়ি, ৫টি এসি, নন-এসি বাসসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম