Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

কষ্টে খেটে খাওয়া মানুষ

তীব্র গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ

Icon

মুসতাক আহমদ

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তীব্র গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ

দাবদাহে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বর্তমানে চরম উষ্ণ বাংলার প্রকৃতি। ভয়ানক গরমে পুড়ছে দেশের অন্তত সাতটি বিভাগের মানুষ।

অন্যান্য এলাকায়ও নেই স্বস্তি। দিনে-রাতে সমান গরম। এ পরিস্থিতিতে ঘরের ভেতরেও টেকা দায়। ফ্যানের বাতাসেও প্রাণ জুড়ায় না।

এমনকি সূর্যাস্তের পরও শান্ত হয় না প্রাণ-প্রকৃতি। প্রকৃতির রুদ্ররূপে দুঃসহ জীবনযাপন করছে মানুষ। সব মিলে ওষ্ঠাগত প্রাণ।

এই গরমে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাহিদশা। দাবদাহে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকেরা। এছাড়া পানিশূন্যতা থেকে ডায়রিয়াসহ টাইফয়েড ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন । এমন অবস্থায় বিশুদ্ধ পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গরমের এই পরিস্থিতিকে আবহওয়াবিদরা দাবদাহ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বিগত কয়েকদিন ধরে এমন অবস্থা চলছে। তবে তা থেকে আশু মুক্তির কোনো সুখবর নেই। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) বলছে, এই অবস্থা আরও অন্তত এক সপ্তাহ চলতে পারে।

আর বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন আরও বেশি, অন্তত ১২ দিন। আগামী ২২ এপ্রিলের পর প্রকৃতি শান্ত হতে পারে। অন্যদিকে বৃষ্টির সঙ্গে তাপমাত্রা নেমে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। কিন্তু ১৬ এপ্রিলের দিকে দেশের কিছু এলাকায় খানিকটা বৃষ্টি হতে পারে। এরপর প্রকৃতিকে শান্ত করার মতো বৃষ্টির দেখা মিলতে পারে ২৪ এপ্রিলের দিকে। অর্থাৎ রোজার মাসে আর স্বস্তিদায়ক আবহাওয়া পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই শান্তির বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছেন না আবহাওয়াবিদরা।

বিএমডির আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান দাবদাহের মূল কারণ দুটি-পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাব ও বৃষ্টিশূন্যতা। তার মতে, এপ্রিল মাসে এমন গরম থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে ভারতের রাজস্থানের মরুভূমির দিক থেকে যে তপ্ত বায়ুপ্রবাহ তৈরি হয়, তা বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। বিহারের কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলও উষ্ণ হয়ে ওঠে। সেটিই পরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে। কিন্তু বৃষ্টির দেখা মিললে আবার স্বস্তি মিলত। বৃষ্টিশূন্যতাও এই দাবদাহকে দিন দিন আরও ভয়ংকর করে তুলছে।

তবে আবহাওয়াবিদরা আরও কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। আকাশের আংশিক মেঘলা অবস্থা, সারাদেশে স্বাভাবিকের ২-৬ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা এবং বাতাসের মৃদু গতিবেগও এই দাবদাহের নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে।

সাধারণত কোনো এলাকার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হলে সেখানে মৃদু দাবদাহ শুরু হয়। এটি ৩৮ ডিগ্রি পার হলে তা পরিণত হয় মাঝারি দাবদাহে। আর ৪০ ডিগ্রি পার হলে সেটাকে তীব্র দাবদাহ বলা হয়। যদি ৪২ ডিগ্রি পার হয়, সেটা অতি তীব্র দাবদাহে রূপ নেয়। মঙ্গলবার দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বুধবার সেই রেকর্ডও ভেঙে গেছে। এদিন সেখানকার তাপমাত্রা ছিল ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে মঙ্গলবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বুধবার তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিএমডি জানায়, মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬টি বিভাগের ওপর দিয়ে বর্তমানে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে-রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ। কিন্তু বুধবার ময়মনসিংহ বিভাগেও দাবদাহ শুরু হয়েছে। সবমিলে দাবদাহভুক্ত জেলার সংখ্যা ৪৯টি।

আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, বর্তমানে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ২-৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশি আছে। গত ৩০ বছরের তাপমাত্রা গড় করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, এর চেয়েও ভয়ানক দিক হচ্ছে, স্থানভেদে কোথাও বাস্তব তাপমাত্রার চেয়েও ৪-৮ ডিগ্রি পর্যন্ত বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, মানুষের শরীর একটি তাপ ইঞ্জিন। শরীরের ভেতর থেকে লোমকুপের মাধ্যমে ঘামের সাহায্যে তাপ বিকিরণ করে। কিন্তু এবারের গরমে তেমন ঘামও দিচ্ছে না। এতে বাড়তি গরম অনুভূত হয়।

আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তাপমাত্রার সর্বোচ্চ অবস্থাটি সাধারণত বিকিরণের মাধ্যমে হ্রাস পায় রাতে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সেটি হচ্ছে না। কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, জাপানের কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত চিত্রে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশের আকাশ প্রায় পুরোটাই মেঘমুক্ত। অর্থাৎ এসব দেশের উচ্চ আকাশে বর্তমানে নিুচাপ অবস্থা বিরাজ করছে। যে কারণে উচ্চ আকাশের শুষ্ক ও ভারি বায়ু নিচে নেমে ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি জমা হচ্ছে। অন্যদিকে ভূ-পৃষ্ঠের দিকে সর্বোচ্চ সংখ্যক বায়ু কণা থাকে। ঊর্ধ্বাকাশ থেকে যখন নতুন করে বায়ুকনা নিচে পড়তে থাকে, তখন ভূ-পৃষ্ঠে স্বাভাবিক সময় অপেক্ষা অনেক বেশি বায়ু কণা কাছাকাছি অবস্থান করতে বাধ্য হয়। এতে উভয় স্তরের বাতাসের মধ্যে সংিঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়। এই ঘর্ষণের ফলে তাপের উৎপন্ন হয় ও ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। গত এক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে মধ্য ও পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের ওপর সর্বোচ্চ তাপমাত্রার দৈনন্দিন রেকর্ড হচ্ছে। এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে, যা ২২ এপ্রিল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে ১৯ ও ২০ এপ্রিলের দিকে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জেলায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠার প্রবল আশঙ্কা আছে।

এদিকে এই দাবদাহের কারণে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। আইসিডিডিআরবি,র এক কর্মকর্তা জানান, তাদের হাসপাতালে দৈনিক সাড়ে ৪শ থেকে ৫শ রোগী আসছে। যদিও মৌসুম অনুযায়ী এই সংখ্যাটা স্বাভাবিক। কিন্তু রোজার পর মানুষের পানি পানের অবস্থা বেড়ে গেলে রোগীর সংখ্যাও বাড়তে পারে। আর এখন যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগই পানিশূন্যতার রোগ নিয়ে আসছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দাবদাহকালে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা থাকে মানুষের পানিশূন্যতার সমস্যায় ভোগার। ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। শরীরে পানির সংকট বেশি দেখা দিলে একটা সময়ে হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া বিশেষ করে শহরাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানিবাহিত সমস্যা দেখা দেওয়ার শঙ্কাও থাকে। তাই এসময়ে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। একজন মানুষের গড়ে দৈনিক ২ লিটার পানি পান করা দরকার। কিন্তু গরমের সময়ে তা আড়াই থেকে ৩ লিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম