বঙ্গবাজার ট্র্যাজেডি: ঝুঁকিতে ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ীরা
ঈদে কমপক্ষে একটি কাপড় কেনার আকুতি
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে সর্বহারা ব্যবসায়ীরা দুঃস্বপ্নের মধ্যে বসবাস করছেন। দিনের শুরুতেই ছুটে আসছেন পোড়া ধ্বংসস্তূপের পাশে। সেখানে নিশ্চিহ্ন দোকানের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তারা।
এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে আছেন মার্কেটের ভাড়াটিয়া দোকানিরা। তারা ক্ষতিপূরণ পাবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তিত। ভবিষ্যতে মার্কেটে ভাড়া দোকানের দখল পাওয়ার চিন্তা তাদের শঙ্কিত করে তুলছে।
তারা বলেন, দোকান মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। আগুনে পোড়ার পর মালিকদের দোকানের দখল পেতেই বেগ পেতে হয়। আমরা তো ভাড়াটিয়া। দুদিন ধরে এ মার্কেটের অনেকেই ফুটপাতে কাপড় নিয়ে বসেছেন। তারা বলেন, দেশবাসীর কাছে একটাই দাবি-আপনারা বঙ্গবাজার থেকে ঈদে অন্তত একটি করে হলেও কাপড় কিনুন। এটিই হবে আমাদের জন্য বড় সহযোগিতা।
শনিবার বঙ্গবাজার এলাকায় সরেজমিন ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনই চিত্র উঠে এসেছে। দিনভর ৪টি ট্রাকে লোহা-লক্কড়সহ অন্যান্য পোড়া মালামাল সরানো হয়। তবে কাজে ধীরগতি দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে জনবল বাড়ানোর দাবি করেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
এদিকে ব্যবসায়ীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের তথ্য সংরক্ষণের কাজও চলছে। ব্যবসায়ী সমিতির নেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রস্তুত করছেন।
অন্যদিনের মতো শনিবারও পুলিশ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জিডি নেয় অনলাইনে। তবে সার্ভার জটিলতায় ভোগান্তির শিকার হন ব্যবসায়ীরা।
শনিবার দুপুরে বঙ্গবাজারে কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের বাসিন্দা ইলিয়াস ২৫ বছর আগে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবাজারের বিভিন্ন দোকানে চাকরি করে তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে চার বছর আগে এখানে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। দোকানে ২৫-৩০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। একটি কাপড়ও বের করা সম্ভব হয়নি ।
তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন কি না, এ নিয়ে চিন্তিত। যদিও দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে তার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, এরপরও তার মাঝে এক অজানা শঙ্কা কাজ করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ইলিয়াস যুগান্তরকে বলেন, যে কোনো মার্কেট আগুনে পুড়লে পরে মালিকদের দখল পেতেই বেগ পোহাতে হয়। আর আমরা তো ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী। আমাদের দোকানের জায়গা তো নিজস্ব নয়। তাই আবারও ব্যবসার জায়গা পাব কি না জানি না। যদি সরকার কিছুটা ক্ষতিপূরণ দেয় এবং বসে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়, তবেই আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া।
গুলিস্তান ইউনিটের একটি দোকানের মালিক আকরাম হোসেন। তিনি গত বছর গুলিস্তান ইউনিটে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
যুগান্তরকে বলেন, গত মাসে এক বছরের জন্য ১ লাখ ১০ হাজার টাকা মালিককে অগ্রিম দিয়েছি। দোকানে যে ২৫-৩০ লাখ টাকার মাল ছিল সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
আকরাম যুগান্তকে বলেন, এই দোকানের আয় দিয়ে আমার সবকিছু চলত। কিন্তু এখন তো পথে বসে গেছি। ক্ষতিপূরণ কতটুকু পাব জানি না। কীভাবে ঘুরে দাঁড়াব, কিছুই মাথায় আসছে না। শুধু এ দুজনই নয়, তাদের মতো অনেকেই ভাড়ায় দোকান নিয়ে শুরু করেছিলেন ব্যবসা। এখন তাদের কিছুই নেই।
এদিকে শুক্রবার থেকে বঙ্গবাজারের দক্ষিণের ফুটপাতে, ফ্লাইওভারের নিচে শতাধিক ব্যবসায়ী কাঠের চকিতে দোকান নিয়ে বসেছেন। শনিবার এখানে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়েছে। দোকানগুলোকে ঘিরে জনসমাগম হলেও তেমন বিক্রি জমে ওঠেনি। সব ব্যবসায়ীর চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ।
তারা বলছেন, ঈদের আগে কিছুটা বেচাবিক্রি হলে তারা হয়তো ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পাবেন। বঙ্গবাজারের গুলিস্তান মার্কেটে জিন্সের প্যান্ট ও শার্টের দোকান ছিল সাইফুল ইসলামের। দোকান পুড়ে এখন তারও ঠিকানা ফুটপাত।
সাইফুল জানান, বাসায় খাবারের টাকা নেই। তাই বাধ্য হয়ে ফুটপাতে দোকান বসিয়েছি। দুটি দোকানের প্রায় ৩২ লাখ টাকার কাপড় পুড়ে গেছে জানিয়ে বঙ্গ কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী মিঠুন যুগান্তরকে বলেন, কোনো প্রণোদনা চাই না, দেশবাসীর কাছে আমার একটাই দাবি-আপনারা বঙ্গবাজার থেকে ঈদে অন্তত একটি করে হলেও কাপড় কিনুন। এটিই হবে আমাদের জন্য বড় সহযোগিতা।
এদিকে শনিবার সকালে বঙ্গবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
আইএফআইসি ব্যাংকের ওই সঞ্চয়ী হিসাব নম্বরের (০২০০০৯৪০৬৬০৩১) মাধ্যমে দেশ-বিদেশ থেকে যে কেউ অর্থ সাহায্য পাঠাতে পারবেন। ওই অ্যাকাউন্টে জমা টাকা প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, তালিকা তৈরি আর ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে আমরা তাদের বুঝিয়ে দেব। তারাই টাকা বণ্টন করবেন।
বঙ্গবাজার কমল্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপের লোহালক্কড় বিক্রির ৪০ লাখ টাকাও ওই অ্যাকাউণ্টে জমা করা হবে। অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঈদের আগে কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে বঙ্গবাজারে অস্থায়ীভাবে দ্রুত বসার ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা ব্যাংকের চেক, ট্রেড লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড, জনিম্ননিবন্ধন কপি, জাতীয় পরিচয়পত্র হারিয়েছেন, তাদের তথ্য ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে লিপিবদ্ধ রাখতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ৬ এপ্রিল এনেক্সকো টাওয়ারের উলটোপাশে ঢাকা জেলা প্রশাসনের একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। এরই মধ্যে ৪০০ কর্মচারী ও ৫০০ মালিক ও ভাড়াটিয়া ব্যবসায়ী তথ্য কেন্দ্রে নিজেদের তথ্য দিয়েছেন। শনিবার দুপুরে তথ্যকেন্দ্রে ব্যবসায়ীদের ভিড় দেখা গেছে।
সার্ভার জটিলতায় জিডিতে ভোগান্তি : বৃহস্পতিবার থেকে বঙ্গবাজারের পাশে অস্থায়ী বুথ খোলে পুলিশ। ওই বুথে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অনলাইনে জিডি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। কিন্তু শুরু থেকেই সার্ভার জটিলতায় ব্যবসায়ীরা অনলাইনে জিডি করতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
বুথে কর্তব্যরত শাহবাগ থানার এসআই সুমন বলেন, ‘সার্ভার স্লো, এ কারণে জিডি নিতে দেরি হচ্ছে। সকাল থেকে কতটি জিডি হয়েছে, সে বিষয়েও জানাতে পারেননি তিনি।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার সকাল ৬টা ১০ মিনিটে বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। এতে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেটের সব দোকান পুড়ে যায়। পাশের এনেক্সকো টাওয়ারসহ আরও কয়েকটিতে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ফায়ার সার্ভিসের অর্ধশতাধিক ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় প্র্রায় ৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।