ঢাকার অনেক শপিংমলে নেই অগ্নিনিরাপত্তা
ঝুঁকিতে ১৩০০ মার্কেট ও বাণিজ্যিক ভবন
‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ ৪৫০ মার্কেট কর্তৃপক্ষ ও ভবন মালিকদের কাছে যাচ্ছে সতর্কবার্তা
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ ৪৫০ মার্কেট কর্তৃপক্ষ ও ভবন মালিকদের কাছে যাচ্ছে সতর্কবার্তা। ফাইল ছবি
রাজধানীতে আগুনের ঝুঁকিতে আছে এমন মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ভবনের তালিকা করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। এই তালিকায় নামিদামি শপিংমলসহ স্থান পেয়েছে ১ হাজার ৩০৫টি মার্কেট ও ভবন। এর মধ্যে ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ৪৫০টি। এসব মার্কেট কর্তৃপক্ষ ও ভবন মালিকদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। তবে আইনি দুর্বলতার কারণে সংস্থাটি কারও বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না।
এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারি এই সংস্থার তালিকাকে গৎবাঁধা আখ্যা দিয়েছেন অনেক মার্কেট পরিচালনা কমিটির নেতারা। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বড় আগুনের ঘটনা ঘটলেই এ নিয়ে হইচই শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানে থেমে যায় সবকিছু। অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না কেউ। মঙ্গলবার বঙ্গবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ আগুনে আটটি মার্কেট পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। তাই কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে সব মহল। বৃহস্পতিবার একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি প্রতিনিধি দল গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন করেছে। পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ সব মার্কেট পরিদর্শনের পর সবাইকে সতর্কবার্তা পাঠানো হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ফায়ার সার্ভিস অন্তত ৪৫০টি মার্কেট ও ভবনের তালিকা নিয়ে মাঠে কাজ করবে। এই তালিকায় গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানশন, রাজধানী সুপার মার্কেট, কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেট, লিলি প্লাজা, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের নামও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ভবনের তালিকা তৈরি করলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে ফায়ার সার্ভিসের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। সংস্থাটিকে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বেশ কিছু ক্ষমতা দিয়ে ২০১৪ সালে ‘অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩’-এর আওতায় একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু পোশাক প্রস্তুতকারীদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে ওই গেজেট স্থগিত করা হয়। এরপর অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ওই আইনের বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা অজানা কারণে আটকে আছে। অথচ প্রস্তাব অনুযায়ী সংশোধিত বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হলেই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ দায়ীদের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করার ক্ষমতা পাবে। তখন তারা অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাজাহান শিকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করলেও আইনি দুর্বলতার কারণে আমাদের পক্ষে তেমন কিছু করার থাকে না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাজউকের হাতে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩’-এর একটি বিধিমালা সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। সেটা চূড়ান্ত করে গেজেট হলে আমরা অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও মালিকদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারব।’
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের প্রাণহানির ঘটনার পর মার্কেট, শপিংমল ও বহুতল বাণিজ্যিক ভবনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে রাজধানীর শপিংমল ও মার্কেট পরিদর্শন করে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। ওই তালিকায় এক হাজার ৩০৫টি শপিংমল ও মার্কেট আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তালিকায় ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’-এই দুই ধরনের ক্যাটাগরি রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চার মার্কেটের সমন্বয়ে গড়া বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্সে আগুন লাগে মঙ্গলবার ভোরে। সেই আগুন মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, এসএসকো টাওয়ার, ইসলামিয়াসহ অন্তত আটটি মার্কেট পুড়ে যায়। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় আরও আছে কাপ্তান বাজার কমপ্লেক্স ভবন-২, ঢাকা ট্রেড সেন্টার, গুলশান শপিং সেন্টার, জব্বার টাওয়ার, রহমানিয়া সুপার মার্কেট, ভূঁইয়া ম্যানশন, গুলশান ভবন মার্কেট, গুলশান-২ ডিএনসিসি কাঁচাবাজার মার্কেট, পিংক সিটি শপিং কমপ্লেক্স, বিদিশা সুপার মার্কেট, সাবেরা টাওয়ার মার্কেট, বাইশ বর সুপার মার্কেট, ল্যান্ড মার্ক শপিং সেন্টার, বনানীর গোলাম কিবরিয়া ম্যানশন, বাংলাদেশ ইউএস মৈত্রী কমপ্লেক্স, বারিধারার নতুন বাজার দোকান মালিক সমিতি মার্কেট, মহাখালীর জননী ভবন মার্কেট, শাহীন ম্যানশন, মহাখালী প্লাজা, জেবা টাওয়ার, কাওরান বাজারের শাহ আলী টাওয়ার, মগবাজারের বাটা বাজার, বেঙ্গল টাওয়ার, আড়ং প্লাজা, বিশাল সেন্টার শপিংমল, রাজ্জাক প্লাজা শপিং কমপ্লেক্স। এছাড়া অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা এলাকার অর্ধশতাধিক মার্কেট আছে ঝুঁকিপূর্ণ।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, গুলশান টাওয়ার, জব্বার টাওয়ার শপিংমল, পুলিশ প্লাজা, রহমানিয়া সুপার মার্কেট, গুলশান-১ নম্বরে ডিএনসিসি মার্কেট, বনানী-বারিধারা- ডিএনসিসি বনানী সুপার মার্কেট, সাদ মুসা সিটি সেন্টার ও মেহেদী মার্কেট। এছাড়া আছে কাওরান বাজার ২ নম্বর সুপার মার্কেট, কাওরান বাজার কিচেন মার্কেট, কাওরান বাজার কামার পট্টি, হাসিনা মার্কেট, কাব্যকস সুপার মার্কেট, ব্র্যাক আড়ং, প্রগতি সরণির হাজী জমির উদ্দিন সুপার মার্কেট, ফজিলা শপিং সেন্টার, ওয়ারীর মুক্ত বাংলা হকার্স মার্কেট, কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্স ভবন-১, খন্দকার ইলেকট্রনিক মার্কেট, শাহবাগের আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেট, নবাবপুরের আ. রহিম মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার, মজনু হার্ডওয়্যার মার্কেট, পল্টনের বায়তুল মোকাররম মার্কেট, পলওয়েল সুপার মার্কেট, সিটি ভবন, জাহাঙ্গীর শপিং কমপ্লেক্স, রমনা ভবন মার্কেট, মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়াম মার্কেট, ভলিবল মার্কেট, গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ঢাকা ট্রেড সেন্টার দক্ষিণ, ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেট-২, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেট, ডন প্লাজা, নবাব প্লাজা, পীর ইয়ামেনী মার্কেট, বংশালের জাকের সুপার মার্কেট, রোজলীন ভিসতা শপিং কমপ্লেক্স, মিরপুরের মিরপুর টাওয়ার নার্শি মার্কেট ও ডাসুরা টাওয়ার।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় থাকা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার নোটিশ করা হয়েছে। কিন্তু এই নোটিশ তারা আমলে নেয়নি। যতক্ষণ না এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের সংশোধন না করবে ততক্ষণ বঙ্গবাজারের মতো আরও অনেক ঘটনার জন্ম হতে পারে।
জানতে চাইলে গুলিস্তানের জাকের সুপার মার্কেটের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় আগুনের ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল আমাদের মার্কেট পরিদর্শনে আসে। এরপর তারা নোটিশ পাঠিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দেয়। সে অনুযায়ী আমরা ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেটের তিনটি ইউনিটেই নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বসিয়েছি। নিচতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত আলাদা পানির লাইন স্থাপন করা হয়েছে। ৩০ হাজার লিটারের আলাদা পানির টাংকি ছাড়াও প্রতিটি ফ্লোরেই নেওয়া হয়েছে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ৭ তলা মার্কেট ‘গুলশান শপিং সেন্টার’। এখানে আছে ৭২৫টি দোকান। ভবনে ওঠানামার জন্য আছে ৮টি সিঁড়ি। নিচতলায় মোবাইল সার্ভিসিং, ঘড়ি মেরামত ও হার্ডওয়্যারের দোকানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা স্পষ্ট। ভবনের দ্বিতীয়তলায়ও একই চিত্র। ছয়তলায় মাত্র একটি স্মোক বা হিট ডিটেক্টর দেখা গেলেও অন্য কোনো তলায় তা দেখা যায়নি। তবে মার্কেটের প্রতিটি তলায় আগ্নিনির্বাপক যন্ত্র (ডিস্টিংগুইশার) দেখা গেছে। এই মার্কেটে একবার আগুন ধরলেও তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে তালিকায় ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ হিসাবে চিহ্নিত এই বাণিজ্যিক ভবন। তবে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দাবি, এই ভবনে অগ্নিঝুঁকি নেই। অগ্নিনির্বাপণের সব যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থা রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস গৎবাঁধা তালিকায় তাদের ভবনের নাম তুলে দিয়েছে। তবে পাশের ডিসিসি মার্কেট দুই দফা আগুনে পুড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
গুলশান শপিং সেন্টারের সাধারণ সম্পাদক হাম্মাদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় এই মার্কেট ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ফায়ার সার্ভিস মার্কেটে ঝুঁকিপূর্ণ নোটিশও ঝুলিয়ে দিয়ে যায়। আমরাও মনে করি এখানে বহুতল মার্কেট হতে পারে। কিন্তু এই ভবনের মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে মামলা বিচারাধীন থাকায় সব কিছু আটকে আছে।