পানির সংকটই আগুন নেভাতে প্রধান অন্তরায়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দ্রুত নিয়ন্ত্রণে বারবার সামনে আসছে পানির সংকটের বিষয়টি। সর্বশেষ মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডেও সেই একই চিত্র দেখা যায়।
পানি সংকটে আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়ায় হাজার হাজার ব্যবসায়ীর শত কোটি টাকার সম্পদ চোখের সামনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। হাতের কাছে পর্যাপ্ত পানি থাকলে মুহূর্তে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, পানির জন্য দিগ্বিদিক ছুটেও তা সংগ্রহ করা যায়নি। কোনো সুযোগও ছিল না। কারণ জনবহুল এ শহরে পানির উৎসগুলো আমরা সবাই মিলে ধ্বংস করেছি। মহানগরীর ভেতরের সরকারি-বেসরকারি পুকুর, সরকারি খাল, জলাশয়, জলাধারগুলো ভরাট করে সুরম্য অট্টালিকা তৈরি করে উন্নয়ন করেছি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাস্তাঘাট, বনভূমি, জীববৈচিত্র্যের মতো জলাধারও যে উন্নয়নের অংশ তা সবাই বেমালুম ভুলে গেছি। এখানেই শেষ না। সামনে আরও বড় বিপদ আরও বড় দুর্ঘটনা আসবে। সরকার যদি এখনই খাল, নদী, পুকুর, দিঘিসহ জলাধারগুলো উদ্ধার না করে তাহলে এর চেয়েও বড় দুর্ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়তে হবে।
জানতে চাইলে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা বলতে বলতে এখন ক্লান্ত। কেউ কর্ণপাত করেন না। কারও মাথাব্যথা নেই। একটি আধুনিক নগরীর জন্য কত শতাংশ রাস্তা, কত শতাংশ বনভূমি, কত শতাংশ জলাধার থাকবে তা নগর পরিকল্পনায় নির্ধারণ করা থাকে। এখন আমরা সব বাদ দিয়ে শুধু ভবন তৈরি ও রাস্তাঘাট করাকে উন্নয়ন মনে করি। জলাধারও যে নগরীর উন্নয়নের অংশ তা কারও জ্ঞানে নেই।
এজাজ আরও বলেন, এখনও ঢাকায় অভরাট সরকারি বেসরকারি ৩২৭টি পুকুর রয়েছে। এ পুকুরগুলো আর যাতে ভরাট না হয় সরকারকে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। বেসরকারি পুকুর প্রয়োজনে সরকার অধিগ্রহণ করবে। অর্থাৎ কোনো ভাবেই পুকুরগুলো ভরাট করতে দেওয়া যাবে না। এ পর্যন্ত আমাদের গবেষণায় ৭৭টি খাল পেয়েছি। এগুলো যে কোনো মূল্যে পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুক্তবারি ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু পুনরুদ্ধারই নয় বরং খালগুলো সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে সরকারিভাবে নিয়মিত খনন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। দখলমুক্ত করতে হবে সব জলাধার। মনে রাখতে হবে আগুন লাগার ঘটনা এখানেই শেষ না। আরও ভয়বহ বিপদ সামনে আসতে পারে।
জানতে চাইলে স্থপতি ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, বঙ্গবাজারের ১০০ গজের মধ্যে ওসমানী উদ্যানের ভেতরে বিশাল বড় একটি পুকুর ছিল। সেই পুকুর ভরাট না করলে পানির সংকট হতো না। পুরান ঢাকার নাজমউদ্দিন রোডের পুকুরগুলো কোথায় গেল? এই মুহূর্তে বিএডিসি কল্যাণপুরে খাল ভরাট করছে। পান্থপথ এলাকার সবচেয়ে বড় পুকুরটা ভরাট করে পানি ভবন তৈরি করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সরকার খাল, পুকুর ও জলাশয় দখলের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। এছাড়া আমরা বিভিন্ন সময় সভা সেমিনারে বলেছি নদীর পানি সামান্য ট্রিটমেন্ট করে সংরক্ষণ করতে। সেই পানি অগ্নিনির্বাপণ, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করাসহ বিভিন্ন কাজে লাগবে। সরকার তা করবে বলে সিদ্ধান্তও নিয়েছে। কিন্তু কাজটি কি রাজউক না সিটি করপোরেশন করবে তা চূড়ান্ত হচ্ছে না। ফলে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
ইকবাল হাবিব বলেন, জলাশয়ও যে উন্নয়নের অংশ তা ভুলে পুকুর খাল ভরাট করে ঢাকাকে মৃত নগরীতে পরিণত করেছি। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ঢাকা মহানগরীতে লেক আছে ৭৯টি। পুকুর আছে ১ হাজার ৫১৬টি। সরকার এ খালগুলো পুনরুদ্ধার করুক। তারপর দেখা যাবে পানির কোনো সংকট থাকে কি না।
তিনি সতর্ক করে বলেন, শহরের তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে। অগ্নিদুর্ঘটনা আরও বাড়বে। এখন থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এখানে আরও দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘটবেই।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও বঙ্গবাজারের এক কিলোমিটারের মধ্যে কমপক্ষে ছয়টি বড় খাল ছিল।
তা হলো, সেগুনবাগিচা খাল, নারিন্দা খাল, ধোলাইখাল, গোপীবাগ খাল, দেবদোলাইখাল ও সূত্রাপুর খাল। এ ছয়টি খালের বাইরে দোলাই নামে একটা নদীও ছিল বঙ্গবাজারের খুব কাছেই। খাল ভরাট করে রাস্তা, কালভার্ট ও অন্যন্যা স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় এসব খাল ও জলাধার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে পানির উৎস। ফলে বিপদের সময় পানির জন্য পাগলের মতো ছোটাছুটি করেও কোন ফল হয়নি।