জড়িত র্যাব কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিতে হবে
উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ
র্যাব হেফাজতে জেসমিনের মৃত্যু
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নওগাঁয় র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এ নির্দেশ দিয়ে আদালত বলেছেন, কমিটিতে জেলা দায়রা জজ সমমর্যাদার একজন ও নওগাঁর মুখ্য বিচারিক হাকিমকে রাখতে হবে। আদেশের অনুলিপি পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে তদন্ত চলার সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িত (সুলতানা জেসমিনকে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া) র্যাব কর্মকর্তাদের সংস্থাটির সদর দপ্তরে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া মামলা ছাড়াই সুলতানা জেসমিনকে তুলে নেওয়া ও গ্রেফতার কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। এ সংক্রান্ত এক আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের দ্বৈত বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনোজ কুমার ভৌমিক। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর, শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান দাউদ।
২২ মার্চ সকালে নওগাঁ শহরের নওজোয়ান মাঠের সামনে থেকে সুলতানা জেসমিনকে আটক করে র্যাব। এরপর র্যাব হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২৪ মার্চ সকালে রামেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন। র্যাবের দাবি, প্রতারণার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। আটকের পর অসুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতালে মারা যান। তবে তার স্বজনদের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুসংক্রান্ত প্রকাশিত খবর ২৭ মার্চ হাইকোর্টের নজরে নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ চেয়েছিলেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। পরে আদালতের নির্দেশে ২৮ মার্চ তিনি হাইকোর্টে এ বিষয়ে রিট আবেদন করেন। রিটে র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর কারণ ও র্যাবের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
সেদিন (২৮ মার্চ) হাইকোর্ট কোনো মামলা ছাড়াই নওগাঁর সুলতানা জেসমিনকে র্যাবের হেফাজতে নেওয়া থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত যে প্রক্রিয়া তা আইনিভাবে কতটুকু সঠিক ছিল এবং র্যাবের কোনো এখতিয়ার ছিল কিনা তা জানতে চান। পরে শুনানির জন্য ৫ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়।
বুধবার অ্যাটর্নি জেনারেল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও সুরতহাল প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, সুলতানা জেসমিনের উচ্চ রক্তচাপ ছিল। তিনি বলেন, এক ব্যক্তির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ মার্চ ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে নওগাঁ সদরের নওজোয়ান মাঠের সামনে থেকে সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়।
পরে জনসাধারণের সামনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। তার আগে আটক ওই নারীর মোবাইল ফোন থেকে অভিযোগসংক্রান্ত তথ্য ও নথি উদ্ধার করা হয়।
এ সময় রিটকারী মনোজ কুমার আদালতে বলেন, এ ঘটনায় কোনো বিষয়ই বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। র্যাব গঠন করা হয়েছিল দাগি চোর-ডাকাত, মাদক চোরাকারবারি ধরতে। এই নারীকে আটক করা হয় ২২ মার্চ। আর ২৪ মার্চ তার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এই আইনে কাউকে গ্রেফতারের এখতিয়ার পুলিশের থাকলেও র্যাবের নেই। তিনি আরও বলেন, এটি (সুলতানা জেসমিনকে আটক, হেফাজত, জিজ্ঞাসাবাদ) সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে করা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সুলতানা জেসমিনের মাথায় আঘাত থাকার কথা বলেছেন, যা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে।
ফলে র্যাবের কর্মকাণ্ড ও নারীর মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। যে কারণে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয় রিটে। পরে আদালত রুলসহ আদেশ দেন।
আদেশের পর সাংবাদিকদের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ ঘটনায় আদালত একটি রুল দিয়েছেন। রুলে আদালত বলেছেন, র্যাব জেসমিনকে যেভাবে তুলে নিয়েছে তা আইনত বৈধ ছিল কিনা। তদন্তের সময়ে অভিযুক্ত র্যাব সদস্যদের সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
পরিবারের প্রতিক্রিয়া : নিহত সুলতানা জেসমিনের মামা নাজমুল হক বলেন, হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটা ভালো। তদন্তের জন্য ৬০ দিনের যে সময় আদালত বেঁধে দিয়েছেন, আমরা চাই যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে তারা যেন বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে ন্যায়বিচার পাব বলে আশাবাদী। কারণ আমরা দেখেছি, প্রকৃত যে ঘটনা তার সঙ্গে র?্যাবের ভাষ্য ও মামলার এজাহারের ব্যাপক গরমিল রয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত হলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে।