যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে এক নম্বরে ইউএই
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৫৭টি দেশে ৪৯ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়া করতে গেছেন। কিন্তু এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাম নেই। কিন্তু ২০২২ সালে ৫৮টি দেশে প্রায় সমানসংখ্যক শিক্ষার্থী যান। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ১১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়তে গেছেন ইউএইতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত সারা বিশ্ব থেকে উচ্চশিক্ষায় বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে পছন্দের শীর্ষে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া উত্তর আমেরিকার অপর দেশ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ওইসব দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা। এছাড়া লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ ও নাগরিকত্বসহ স্থায়ী বসবাসের সুযোগ। বিপরীত দিকে সংযুক্ত আমিরাতের কোনো ইউনিভার্সিটিই বৈশ্বিক কিউএস র্যাংকিংয়ে ৯০০-এর মধ্যে নেই। লেখাপড়ার আকর্ষণীয় দেশগুলোর তালিকায়ও কখনোই ছিল না। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নাগরিকত্ব দেয় না। এ অবস্থায় হঠাৎ করে এমন একটি দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্য হওয়া নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটি অংশ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিনিয়োগের তথ্য বের হচ্ছে। একই সঙ্গে আলোচনায় আছে অর্থ পাচারের বিষয়টিও। তবে সন্তানদের পড়তে পাঠানোর সঙ্গে টাকা পাচারের বিষয় জড়ানোয় অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখেন।
জানতে চাইলে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী যুগান্তরকে বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এভাবে শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসার নানা কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, আমেরিকা-যুক্তরাজ্যসহ গতানুগতিক পছন্দের দেশগুলো হয়তো ২০২২ সালে শিক্ষার্থী নেওয়া কমিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশে গমনের ক্ষেত্রে সহজে ভিসা প্রাপ্তির বিষয়টিও আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাধারণত কাজের জন্য গিয়ে থাকেন বাংলাদেশিরা। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণ ভিসায় যান। এখন যদি সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘স্টুডেন্ট ভিসা’ সহজলভ্য হয়, তাহলে সেটা গ্রহণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে অর্থ পাচার বা সন্তানকে লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে টাকা পাঠানোর বিষয়টি মুখ্য নয়, দ্বিতীয় বিষয় হতে পারে। কেননা, যারা টাকা পাচার করেন, গবেষণায় দেখা গেছে, তারা আগে টাকা পাঠিয়ে থাকেন। পরে পরিবার স্থানান্তর করেন। সুতরাং, বিদেশে এভাবে শিক্ষার্থী যাওয়ার সঙ্গে অর্থ পাচারকে সরাসরি সম্পৃক্ত করা যায় না।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার (ইউনেস্কো) ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিদেশে লেখাপড়া করতে যাওয়া সংক্রান্ত চিত্রটি পাওয়া গেছে। সংস্থাটি বলছে, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে বিশ্বের ৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই গেছেন সর্বাধিক ৮৬৬৫ জন। দ্বিতীয় স্থানে আছে মালয়েশিয়া। সেখানে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫৪৮ জন। শীর্ষ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানের দেশ দুটি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। সেখানে যথাক্রমে ৫৬৪৭ ও ৫১৩৬ জন পড়তে গেছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের পঞ্চম আর ষষ্ঠ স্থানে আছে জার্মানি আর যুক্তরাজ্য। দেশ দুটিতে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হচ্ছে, ৩৯৩০ ও ৩১৯৪ জন। সপ্তম থেকে দ্বাদশ স্থানে থাকা দেশগুলো হচ্ছে-ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, সুইডেন, সাইপ্রাস। এসব দেশে ওই বছর যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হচ্ছে-২৭৫০, ২৪৩৬, ১১৭৬, ১১৬৮, ৯৭৩, ৯০৭ জন। উল্লিখিত বছরে সবচেয়ে কম গেছেন ম্যাকাওতে, ৫ জন। সর্বনিু ১শ শিক্ষার্থী গেছেন এমন দেশ ২৫টি। এগুলোর মধ্যে আছে-ফিনল্যান্ড, তুরস্ক, কাতার, থাইল্যান্ড, রাশিয়া, এস্তোনিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, নিউজিল্যান্ড, চীন-হংকং, ডেনমার্ক, ইতালি, ওমান, ইউক্রেইন, ফ্রান্স এবং পর্তুগাল।
কিন্তু সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালে সর্বাধিক শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) গেছেন। আর এই সংখ্যাটি ১১ হাজার ১৫৭ জন। ফলে দ্বিতীয় স্থানে চলে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে উল্লিখিত বছরও একই সংখ্যক শিক্ষার্থী গেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পরের স্থান মালয়েশিয়া ধরে রাখলেও ২০২২ সালে শিক্ষার্থী গেছেন ৬ হাজার ১৮০ জন, যা ২০২১ সালে ছিল ৭৫৪৮ জন। তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ায় গেছেন ৫ হাজার ৬৪৭ শিক্ষার্থী। আর পঞ্চম অবস্থানের দেশ কানাডায় গেছেন ৫ হাজার ১৩৬ জন। এছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪, জাপানে ২ হাজার ৮০২, ভারতে ২ হাজার ৭৫০ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পাড়ি জমান লেখাপড়ার লক্ষ্যে। ২০২১ সালের তালিকায় মিসর ছিল না। কিন্তু সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই দেশটিতে ১৭০ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতে গেলে বলে উল্লেখ আছে।
‘ওপেন ডোরস রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রতিবছর প্রকাশ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্স ব–্যরো এবং ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন ইনস্টিটিউট। এতে অবশ্য বলা হয়, ২০২১-২২ শিক্ষবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে সারা বিশ্ব থেকে ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫১৯ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করতে গেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশি ১০ হাজার ৫৯৭ জন আছে, যেটি তালিকার ১৩ অবস্থানে আছে। এই হিসাব অবশ্য ইউনেস্কোর সঙ্গে মিলছে না। তবে এ হিসাবটি ধরে নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে শিক্ষার্থী যাওয়ার সংখ্যাটি বেশি দেখা যাচ্ছে।
বিদেশে এভাবে শিক্ষার্থী চলে যাওয়ার পেছনে নানান কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি গবেষণারত বাংলাদেশি শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতাসহ বিকশিত হওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবেই মূলত মেধাবী তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ উন্নত দেশে পাড়ি জমায়। এ ক্ষেত্রে তাদের আকৃষ্ট করে উন্নত দেশের গবেষণা, প্রযুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা, জীবনমান, আইনের শাসন আর স্থিতিশীলতা। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে শিক্ষার্থীরা কেন গেছে সেটা গবেষণার দাবি রাখে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশ অনায়াসে বলতে পারবে।
সার্চ ইঞ্জিন গুগলে র্যাংকিং ওয়েব অব ইউনিভার্সিটিজে দেখা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড আরব আমিরাতস ইউনিভার্সিটি। কিউএস র্যাংকিংয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থান ৯১৮তম। দেশটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে খলিফা ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব সারজাহ। এ দুটির বৈশ্বিক র্যাংকিং হচ্ছে যথাক্রমে ৯৭৭ ও ১১২০। আর চতুর্থ শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব সারজাহ, যেটির বৈশ্বিক র্যাংকিং ১৪৪০। ইউএইর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা কমিশন ফর একাডেমিক অ্যাক্রেডিটেশনের (সিএএ) ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, বতর্মানে দেশটিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে ৭২টি।
উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্ট এক বিশেষজ্ঞ বলেন, হঠাৎ করে এই দেশটি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দে এক নম্বরে উঠে আসার পেছনের কারণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার যথেষ্ট জায়গা আছে। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওই দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের নামে অর্থ পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির তথ্যে। সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন রেখে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন অন্তত ৪৫৯ বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য আছে। এর মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের গোল্ডেন ভিসা নিয়েছেন অনেকে। এর জন্যও মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ধরনের ব্যক্তিরাই তাদের সন্তানকে পাঠিয়েছেন সেখানে।
বর্তমান শতকের শুরুর দিকে মালয়েশিয়া পরিণত হয়েছিল একশ্রেণির বাংলাদেশির ‘সেকেন্ড হোম’। তখন ওই দেশটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য যাওয়ার প্রবণতাও বেড়ে গিয়েছিল। সেই ধারা দেশটি এখনো ধরে রেখেছে। দেশটি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ধারণ করার ক্ষেত্রে সবসময় দ্বিতীয়-তৃতীয় অবস্থানে আছে।