কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর
ডলার সংকটের কবলে রানওয়ে সম্প্রসারণ
থমকে গেছে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ * ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা আছে; কিন্তু ডলারের জন্য এলসি খুলতে পারছে না
মুজিব মাসুদ
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডলার সংকটে থমকে গেছে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণ প্রকল্প। এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে না পারায় এক বছর ধরে প্রকল্পের কোনো মালামাল আমদানি করা যাচ্ছে না। বিল দেওয়া যাচ্ছে না প্রকল্পের বিদেশি ঠিকাদারকে। পর্যাপ্ত টাকা থাকার পরও ডলার কিনতে না পারায় ব্যাংক এলসি খুলতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই মুহূর্তে তাদের জরুরি ভিত্তিতে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্রয়োজন। কিন্তু এর সংস্থান হচ্ছে না। এ অবস্থায় থমকে গেছে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ও আকর্ষণীয় রানওয়েটির নির্মাণকাজ।
জানা যায়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বিষয়টি সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবহিত করেছেন। এরপরও কাটছে না এলসি জটিলতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত এলসি জটিলতা না কাটলে আগামী বছর মে মাসে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হবে না। এতে ব্যয়ও বেড়ে যাবে।
বেবিচক চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি প্রকল্প। দেশের পর্যটন খাতকে বিশ্ববাসীর দরবারে তুলে ধরার জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে রানওয়েটির ডিজাইন করা হয়েছে। আগামী ৫০ বছরের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, এলসি খোলার জন্য অমি অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার যোগাযোগ করেছি। এলসি জটিলতা কাটিয়ে যথাসময়ে কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে না পারলে রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজের গতি শ্লথ হয়ে যাবে। যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।
দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ও মনোমুগ্ধকর এই রানওয়েটির অর্ধেক অংশ সাগরে আর অর্ধেক অংশ স্থলভাগে পড়েছে। স্থলভাগের নির্মাণকাজ হয়ে গেলেও জোরেশোরে চলছিল সাগরের অংশে নির্মাণকাজ। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ডলার সংকটে কাজের গতি কমে যায়। প্রকল্পের ভান্ডারে পর্যাপ্ত দেশীয় মুদ্রা আছে। কিন্ত ডলার সংকটে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে পারছে না ব্যাংক। এ মুহূর্তে স্থানীয় একটি ব্যাংকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ দেশীয় মুদ্রা জোগান দিলেও ডলার দিতে পারছে না ব্যাংক। এ কারণে বন্ধ হয়ে গেছে প্রকল্পের অন্যতম সামগ্রী পাথর, বিটুমিন, লাইটিং পণ্যের আমদানি এলসি। ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের কাছে ডলার নেই। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডলার সংকটে ঠিকাদারের বিলও পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ হচ্ছে সমুদ্রের জলরাশির ওপর। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দিনরাত সাগরজল ছুঁয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ওঠানামা করবে এই রানওয়েতে। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সমুদ্রে সম্প্রসারণ প্রকল্প’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশে প্রথমবারের মতো সমুদ্রবক্ষে নির্মিতব্য ১৭০০ ফুটের রানওয়ের নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যার পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। রানওয়ের অন্তত ৭০০ ফুট থাকবে সমুদ্রের পানির ওপর। এটিই হবে দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে। বিমানবন্দরটি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলে কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক বিকাশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চাংজিয়াং ইচাং ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো (সিওয়াইডব্লিউসিবি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
বেবিচক সূত্রমতে, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১০ হাজার ৫০০ ফুট। সাগরবক্ষে বিস্তৃত হওয়ার পর কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের দৈর্ঘ্য হবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট। এটি হবে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজার থেকে সরাসরি পূর্ণ লোডে সুপরিসর আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা, সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ ক্যাট-১ লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের ফলে রাত্রিকালীন বিমান পরিচালনা, বিমানবন্দরে যাত্রী ও কার্গো পরিবহণ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আকাশপথে দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন সম্ভব হবে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরে বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস-বাংলা, এয়ার এক্সট্রা, নভোএয়ারের দৈনিক ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ৬০ থেকে ৭০টি ফ্লাইট ওঠানামা করছে। কক্সবাজার-যশোর রুটে চিংড়ি পোনা সরবরাহ দিচ্ছে কয়েকটি কার্গো বিমান।
বেবিচক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান বলেন, রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনীতির বিকাশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। এই বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক এভিয়েশন হাব হিসাবে ব্যবহার হবে। আন্তর্জাতিক টার্মিনাল হবে, বিদেশি পর্যটকরা সরাসরি কক্সবাজার আসার সুযোগ পাবেন। ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরও গতি আসবে। রানওয়ে সম্প্রসারণকাজ শেষ হলেই এখানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ওঠানামা করতে পারবে ৩৮০-এর মতো সুপরিসর এয়ারবাস।