দুবাইয়ে আরাভের অঢেল সম্পদের নেপথ্যে কারা
কথোপকথনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাসহ নাম আসছে অনেকের * আরাভ খান হাতের পুতুল, পেছনে বড় শক্তি আছে -ড. জিয়া রহমান
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পুলিশ পরিদর্শক খুনের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম যেন এক রহস্যময় ব্যক্তি। দিনমজুরের ছেলে দুবাইয়ে কীভাবে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হলেন-সেই হিসাব মেলাতে পারছেন না কেউ। স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন নিয়ে বিতর্কের পর থেকে দফায় দফায় নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলেছেন তিনি।
কিন্তু কোথাও বিশাল সম্পদের উৎস নিয়ে কথা বলেননি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সোহাগ মোল্লা নামে পরিচিত এই ব্যক্তি। তার সঙ্গে এক ব্যক্তির কথোপকথনের রেকর্ড ঘুরছে ফেসবুকে।
দুজনের ওই আলাপে সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিন ব্যক্তির নাম এসেছে। তবে আরাভের উত্থানের পেছনে তাদের নাম কেন আসছে, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই রেকর্ডে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আরাভ খান কোনো হাতের পুতুল মাত্র। এর পেছনে বড় বড় শক্তি আছে। বুধবার দুবাইয়ে ‘আরাভ জুয়েলার্স’ উদ্বোধনের কিছুদিন আগে কোটালীপাড়া ছাড়েন আরাভের দুই বোন ও মা-বাবা।
এলাকা ত্যাগের সময় স্থানীয়দের জানান, তারা দুবাই যাচ্ছেন। প্রশ্ন উঠেছে-স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগেই কি সম্ভাব্য বিতর্কের বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন আরাভ? তা নাহলে কেন তিনি পরিবারকে আগেভাগেই এলাকা থেকে সরিয়ে নিলেন?
বৃহস্পতিবার ফেসবুক লাইভে আরাভই বলেন, ‘কয়েকদিন আগেও তাকে সেভাবে কেউ চিনত না।’
এ কারণেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দুবাই থেকে দেশে বড় পরিসরে আওয়াজ দিতে চেয়েছেন আরাভ। তাই সেখানে স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করাতে সাকিব আল হাসানের মতো আলোচিত তারকা ও সমালোচিত কয়েকজনকে টার্গেট করেন। আসলে আরাভকে সামনে রেখে নেপথ্যে থেকে একটি বড় চক্র এই কাজটি করছে। এমন পরিস্থিতিতে চক্রটিকে খুঁজে পেতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাছাড়া দেশ থেকে দুবাই গিয়ে দোকান উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আরাভ খান ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বা অর্গানাইজড ক্রাইমের একজন জ্বলন্ত উদাহরণ। এ ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, আরাভ খান একটা হাতের পুতুল মাত্র। এর পেছনে আরও বড় বড় শক্তি আছে; যারা আন্তর্জাতিক অপরাধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। আরাভের অঢেল টাকার মালিক হওয়া সেটাই প্রমাণ করে। পেছনে শক্তিশালী গ্রুপ বা চক্র না থাকলে এমনটি সম্ভব না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যারা উচ্চপদস্থ, ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, তারা যে সহজেই আইনকে প্রভাবিত করতে পারেন, সেটা আমরা কমবেশি সবাই অনুভব করতে পারি। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্যই আইনটা বড় কঠিন। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় পর্যায়-সব জায়গায় চিত্রটা এমনই।’
দেশ থেকে টাকা নিয়ে আরাভকে দুবাইয়ে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে ২০২০ সালে আরাভ ভারতের পাসপোর্ট সংগ্রহ করে দুবাই গিয়ে এত টাকা পেলেন কীভাবে? আরাভের উত্থানের বিষয়টি সামনে আসার পর সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তার নাম ঘুরেফিরে এসেছে। তিনিই আরাভকে স্বর্ণ ব্যবসার জন্য টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
যদিও এক ফেসবকু লাইভে আরাভ দাবি করেছেন, তার এসব কর্মকাণ্ডে পুলিশের সর্বোচ্চ এক কর্মকর্তার সহযোগিতার অভিযোগ সত্য নয়।
এর মধ্যেই শুক্রবার আরাভের সঙ্গে এক ব্যক্তির কথোপকথনের রেকর্ড ভাইরাল হয়। সেখানেও উঠে আসে তিনটি নাম।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আরাভ খুনি। সে পুলিশের এক পরদর্শককে খুন করেছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনলেই সব রহস্যের জট খুলবে। আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, আরাভ খানকে ফেরাতে সম্ভাব্য দুটি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তারা। একটি হলো-আরব আমিরাত ও ভারতের সহযোগিতা। অন্যটি হলো-সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) পারস্পরিক সহযোগিতা। ইতোমধ্যে তাকে বিদেশ থেকে গ্রেফতারের ব্যবস্থা গ্রহণে ঢাকার এনসিবি-কে চিঠি দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এতে তার সাত কপি ছবি, ২৪ পাতার ওয়ারেন্টের কপি, দুই পাতার এফআইআর, তিন পাতার এনআইডি তথ্য ও ভারতীয় পাসপোর্টের কপি সংযুক্ত করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান যুগান্তরকে জানান, আরাভকে ফেরানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের মতোই আরাভকে ফেরানো হয়তো সহজ হবে না। কারণ দুবাইয়ে তার শক্ত খুঁটি রয়েছে। এ কারণেই পুলিশ পরিদর্শক খুনের চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েও সে দম্ভোক্তি নিয়ে লাইভে এসে তাকে ঘিরে সৃষ্ট ঘটনাগুলো মোকাবিলার ঘোষণা দিয়েছে।’
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোহাগ মোল্লা ওরফে আরাভ আশুতিয়া গ্রামের হাঁড়ি-পাতিলের ফেরিওয়ালা মতিয়ার রহমান মোল্লার ছেলে। ২০০৫ সালে চিতলমারী সদরের একটি বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। এরপর দারিদ্র্যের কারণে ২০০৮ সালে চিতলমারী থেকে ভাগ্যের অন্বেষণে ঢাকায় আসেন। পাঁচ-সাত বছর ধরে তিনি এলাকায় যান না বলে হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজাহারুল আলম পান্না নিশ্চিত করেছেন। আর কয়েকদিন আগে সোহাগ মোল্লা (আরাভ) দুই বোন ও মা-বাবাকে দুবাই নিয়ে গেছেন বলে জানিয়েছেন তার চাচাতো ভাই ফেরদৌস মোল্লা।
কোটালীপাড়া থানার ওসি জিল্লুর রহমান বলেন, সোহাগ মোল্লাই মোল্লা আপন, রবিউল ইসলাম রবি, শেখ হৃদি, আরাভ খান নামে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ৯টি ওয়ারেন্ট আমার থানায় এসেছে। ওয়ারেন্টগুলো তামিল করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার (সোহাগ) কোনো হদিস পাইনি।
২০১৮ সালের ৭ জুলাই রাজধানীর বনানীর একটি ফ্ল্যাটে খুন হন পুলিশ পরিদর্শক মামুন। ওই ঘটনায় হওয়া মামলার চার্জশিটভুক্ত ৮নং আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ। হত্যাকাণ্ডের পরপরই রবিউল ওরফে আরাভ ভারতে পালিয়ে যান। ২০২০ সালে রবিউল ভারতের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নং ইউ ৪৯৮৫৩৮৯।
ওই বছরের ২৮ জুলাই কলকাতা থেকে ইস্যু করা পাসপোর্টে রবিউলের নাম আরাভ খান হিসাবে উল্লেখ করা হয়। রবিউল তার নামে একজনকে আত্মসমর্পণ করার জন্য ভাড়া করেছিলেন। ভাড়া করা ওই ব্যক্তি আত্মসমর্পণের পর ৯ মাস কারাগারে ছিলেন। ওই মামলায় ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল গোয়েন্দা পুলিশ রবিউলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে। আরাভ এখন দুবাইয়ে আছেন। সেখানেই গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ।