সিদ্দিকবাজার ট্র্যাজেডি
বেসমেন্ট তৈরিতে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি তৈরিতে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। ভবনটির বেসমেন্টও তৈরি হয়েছে অবৈধভাবে। আর অনুমোদনহীন বেসমেন্টে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে কুইন্স ক্যাফের রান্নাঘর। যেটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, এই অবৈধ বাণিজ্যিক স্থাপনায় দেওয়া হয়েছে তিতাসের গ্যাস সংযোগ। গ্যাস, বিদ্যুৎ, স্যুয়ারেজসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী সংস্থার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর লোভ, উদাসীনতা ও অবহেলার সুযোগ নিয়ে এসব অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ভবনের মালিক এবং ব্যবহারকারীদের এই ধরনের অপরাধের জন্যই মূলত এতগুলো মানুষের প্রাণ ঝরেছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এসব তথ্য। এদিকে ভবন নির্মাণের আগে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে শুক্রবার সকাল থেকে নানা ধরনের প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঘটনাস্থলে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা।
ঘটনার চার দিন পেরোলেও বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মূল নকশা হাতে পায়নি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ফলে অবৈধ ভবনের বিষয়ে ধারণা পাওয়া গেলেও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি ভবনটি কত তলা পর্যন্ত বৈধ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ধসে পড়া ঠেকাতে পিলার মেরামতে কাজ করছে রাজউক। তবে ভবনটি মেরামতের পর ব্যবহার করা যাবে কিনা-সে ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি রাজউক।
সংস্থাটি বলছে, দেড় থেকে দুই মাস পর জানা যাবে ভবনটি ব্যবহার করা যাবে কিনা। এ অবস্থায় এখনো বন্ধ রাখা হয়েছে ক্যাফে কুইন ভবনের সামনের নর্থ সাউথ সড়কের যান চলাচল। এ ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে বংশাল থানায় একটি মামলা হয়েছে। তবে ধ্বংসস্তূপের কারণে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত দল। পরে ভবনের বাইরে থেকে বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করেন তারা।
রাজউক কারিগরি কমিটির সদস্য রঞ্জন মণ্ডল বলেন, ভবনটির মালিকের দেওয়া দুটি নকশা হাতে এসেছে। যার একটিতে পাঁচতলার অনুমোদন রয়েছে, সে হিসাবে অনুমোদন ছাড়াই ওপরে দুইতলা বাড়ানো হয়েছিল। ভবন মালিকরা একটা দশতলার ড্রয়িংও বের করেছেন। কিন্তু সেটির ওপর আমরা অনুমোদনের কোনো স্বাক্ষর পাইনি। ওনারা বলেছেন, ওনারা রাজউকে আবেদন করেছেন ও তাদের অনুমোদনও আছে। কিন্তু এই অনুমোদনের কপি এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেননি তারা।
ধস ঠেকানোর ব্যবস্থা : বিস্ফোরণের চতুর্থ দিন শুক্রবার সকাল থেকেই ভবনটির ধসে পড়া ঠেকাতে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পিলার রক্ষার কাজ চলছিল। যা শুরু হয় বৃহস্পতিবার রাত থেকে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সংস্থাটি এ কাজের দায়িত্ব দেয়। তারা ভবনের ক্ষতিগ্রস্ত কলামে স্টিলের পাইপ (মাইল্ড স্টিল বা এমএস পাইপ) দিয়ে অস্থায়ী ঠেকা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত করার চেষ্টা চলছে। ভবনটির সামনের অংশের ক্ষতিগ্রস্ত কলামগুলোর পাশে ওই পাইপগুলো স্থাপন করে শুরু হয় যাবতীয় কার্যক্রম। এরপর নিচতলার মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ওই পাইপ দেওয়া হয়।
কর্মরত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, একেকটি পাইপের আয়তন ৬ ইঞ্চি। আর লম্বায় ২০ ফুট। প্রয়োজন অনুযায়ী কেটে পাইপ বসানো হয়েছে। তবে বিস্ফোরণে ভেঙে পড়া ভবনের নিচে পানি জমে ছিল। সেজন্য কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। পরে সেচে এই পানি সরানো হচ্ছিল।
রাজউকের কর্মকর্তারা জানান, ভবনটি ভাঙার বিষয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এটিকে কতটা ঝুঁকিমুক্ত করা যায় আপাতত সেদিকেই নজর তাদের। ভবনের ভেতরে গিয়ে কাজ করার অনুমতি মেলেনি। সেজন্য আপাতত বাইরের দিকের কলামে সাপোর্ট দেওয়ার কাজ চলছে। অনুমতি পেলে ভবনের ভেতরের দিকেও কাজ করা হবে।
রাজউক কারিগরি কমিটির সদস্য রঞ্জন মণ্ডল এ প্রসঙ্গে বলেন, বৃহস্পতিবার ৯টা থেকে এখন পর্যন্ত ৪টা কলামে আমরা প্রপিং করেছি। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে করা হবে। তবে এই মুহূর্তে জরুরি হলো সামনের দিকে ব্লক করা। কংক্রিটের বা অন্য কোনো ব্লকার দিতে হবে। কাজের সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভবনের সামনের রাস্তাও ছেড়ে দিতে হতে পারে।
আলামত সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা : এদিকে ধ্বংসস্তূপের কারণে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত দল। শুক্রবার সকালে আলামত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভবনটিতে যান সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। কিন্তু ভবনটির নড়বড়ে অবস্থার কারণে ভেতরে প্রবেশ করতে না পেরে বাইরে থেকে সংগ্রহ করেন বিস্ফোরণের আলামত।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, বিস্ফোরণের ধাক্কায় গ্রিল ছিটকে বেরিয়ে গেছে। কোনো এক্সপ্লোসিভ বা গ্যাস ছিল কিনা সেটি আমরা পরীক্ষা করতে পাঠাব। ভেতরে যাওয়া গেলে আরেকটু ভালোভাবে পুরো ব্যাপারটা আমরা তদন্ত করতে পারতাম।
বিল্ডিং কোড মানার দাবি প্রকৌশলীদের : ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণের অনুরোধ জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা। তাহলে সিদ্দিকবাজারের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে জানান তারা। শুক্রবার দুপুরে সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরিত ভবনের সামনে এক মানববন্ধনে ‘ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনের ব্যানারে এমন দাবি জানান প্রকৌশলীরা।
মানববন্ধনে প্রকৌশলীরা জানান, অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা ও রাজউকের বিধিমালা মেনে ভবন নির্মাণ করলে সিদ্দিকবাজারের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। আর বিল্ডিং কোড মানলে সবকিছু মানা হয়ে যায়। এজন্য এই বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবতে হবে।
মানববন্ধনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এম মাহাম্মুদুর রশিদ বলেন, আমরা মূলত ফায়ার সিকিউরিটি এবং সেফটি নিয়ে কাজ করি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করা। ভবন ও ফ্যাক্টরিগুলো ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, রাজউকের বিধিমালা, অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা মেনে নির্মাণ করা উচিত। আইন মেনে যদি ভবনগুলো নির্মাণ করা হয় তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, রানা প্লাজা এবং তাজরীন গার্মেন্টের দুর্ঘটনার পর বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি নিরাপদ এবং বিদেশে খ্যাতিসম্পন্ন। আগের মতো আর দুর্ঘটনা ঘটছে না। এভাবে যদি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধিমালা মেনে চলি তাহলে সিদ্দিকবাজারের মতো ঘটনা ঘটবে না।
বংশাল থানায় মামলা : ক্যাফে কুইন ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বংশাল থানায়। বৃহস্পতিবার রাতে অবহেলার অভিযোগ এনে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেছে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে বংশাল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মুজিবুর রহমান বলেন, সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় অবহেলার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করেছে। মামলায় অজ্ঞাতপরচিয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।
বংশাল থানা সূত্রে জানা যায়, অবহেলার অভিযোগে ৩০৪-ক/৪২৭ ধারায় মামলাটি হয়েছে। মামলায় তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, ভবনের গ্যাস সংযোগ ও নকশাসহ কী কী গাফিলতি রয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কুইন্স ক্যাফের অবৈধ রান্নাঘরটিকে বিভিন্ন রিকনস্ট্রাকশন, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করা হয়েছে। সেখানে গ্যাসের লিকেজজনিত সমস্যা, পয়োবর্জ্যে সৃষ্ট গ্যাস নিষ্কাশন ও সুব্যবস্থাপনার কোনো সুযোগ না রেখেই ভবনের মালিক এবং ব্যবহারকারীরা অর্থের লোভে, অবৈধভাবে বেসমেন্ট ও গ্রাউন্ড ফ্লোরকে ব্যবহার করে আসছিলেন।
এর আগে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে পুলিশ। বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনায় দুই ভবন মালিকসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। পরে বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে তোলা হলে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
সড়ক বন্ধ, ভোগান্তি : বিস্ফোরণের পর থেকে বন্ধ রয়েছে ক্যাফে কুইন ভবনের সামনের সড়কের একাংশ বন্ধ রয়েছে। অন্য পাশ দিয়ে দুই দিকের যানবাহন চলাচল করছে। এতে গুলিস্তান, পল্টন, পুরান ঢাকা এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রী ও পথচারীরা। বন্ধ সড়ক কবে খুলে দেওয়া হবে-তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। তবে ধসে পড়া থেকে ভবনটিকে ঠেকাতে রাজউকের কাজের পর এটি খুলে দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
শুক্রবার ভবনটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনাস্থল ফিতা টানিয়ে ঘেরাও করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে রয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ সদস্যরা। উদ্ধার অভিযান না চললেও তারা সেখানে সতর্ক অবস্থানে থাকার কথা জানিয়েছেন। সড়কের উভয় পাশে বেশ কয়েক গজ দূরত্বে রয়েছে ব্যারিকেড। কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ভবনের গায়ে ঝুলছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ লেখা ব্যানার। বিস্ফোরণের ঘটনার পর চতুর্থ দিনেও সেখানে ব্যাপক জটলা রয়েছে মানুষের।
বংশাল থানার ওসি মুজিবুর রহমান বলেন, সড়কের পূর্ব অংশ দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। কারিগরি কমিটি বলার পর বন্ধ সড়ক খুলে দেওয়া হবে।