নেপথ্যে দেশি-বিদেশি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট
পুরোনো ট্রান্সফরমার নতুন মোড়কে
মুজিব মাসুদ
প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার নিয়ে চলছে ভয়ংকর কারসাজি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রান্সফরমার চুরি করছে একটি শক্তিশালী চক্র। সেগুলো রিসাইক্লিং করে নতুন মোড়কে ফের বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
তাদের মতে, চুরি করা ট্রান্সফরমার ক্রয় করছে কতিপয় উৎপাদনকারী কোম্পানি ও রিপেয়ারিং ব্যবসার একটি সিন্ডিকেট। সঙ্গে আছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডসহ (আরইবি) কয়েকটি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা।
এছাড়া এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি বিদেশি চক্রও। দেশি-বিদেশি এসব সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটই মূলত ট্রান্সফরমার কারসাজির নেপথ্যে রয়েছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, চক্রটি চুরি করে আনা ট্রান্সফরমার প্রথমে ভেঙে এর ভেতরের অংশগুলো আলাদা করে নেয়। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যবান কপার, ট্রান্সফরমার অয়েল, ট্রান্সফরমার বডিতে ব্যবহৃত স্টিল শিট, ট্রান্সফরমার উৎপাদনে ব্যবহৃত অন্যতম দামি উপাদান ‘কোর’।
এরপর চক্রটি এগুলো কখনো আলাদাভাবে চড়া দামে বিক্রি করে দেয়। আবার কখনো এসব উপাদান দিয়ে নতুন করে ট্রান্সফরমার বানানো হয়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নামে-বেনামে এরকম অর্ধশত অসাধু ট্রান্সফরমার উৎপাদন ও রিপেয়ারিং কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এরাই নামে-বেনামে গ্রাহক ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে অপেক্ষাকৃত কমদামে বিক্রি করছে নিুমানের এসব ট্রান্সফরমার।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চুরি করে আনা এসব স্পেয়ার্স পার্টস দিয়ে নতুন ট্রান্সফরমার তৈরি হওয়ায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যার কারণে ছোট আঘাত, পাখির ঝাপটা কিংবা হালকা ঝড়-বাতাসে বিস্ফোরিত হচ্ছে ট্রান্সফরমার। পাশাপাশি বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে কম দামি এসব ট্রান্সফরমারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশে চুরিও বেড়েছে। আর চুরি করতে গিয়ে প্রায়শ বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এসব চোরের দল। এতে বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
দেশের শীর্ষ ট্রান্সফরমার উৎপাদনকারী কোম্পানি এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হুমায়ুন রশীদ যুগান্তরকে বলেন, দেশে বর্তমানে ৩০টির মতো ট্রান্সফরমার উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিকমানের। বিদেশেও রপ্তানি করছে। আমার জানা মতে, এসব কোনো কোম্পানি এই অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।
তিনি বলেন, প্রতিটি ট্রান্সফরমারের একটি সিরিয়াল নম্বর থাকে। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী এর টেস্ট সার্টিফিকেট আছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো এসব না দেখে ক্রয় করার কথা নয়। এই অপরাধমূলক কাজ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যথায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার এই শিল্প হুমকির মুখে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিতরণ ও ডিস্ট্রিবিউশন লাইন নিয়ে রাষ্ট্র ভয়ংকর ঝুঁকিতে পড়বে। এছাড়া ট্রান্সফরমার রপ্তানিতে বিশ্বব্যাপী দেশের যে সুনাম আছে, সেই ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে।
দেশের বিদ্যুৎ বিতরণ সিস্টেমে বর্তমানে ছোট-বড় ৩০ থেকে ৪০ লাখ ট্রান্সফরমার রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ট্রান্সফরমার আছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীন সমিতিগুলোর আওতায়। আরইবিতে বর্তমানে ট্রান্সফরমারের সংখ্যা ১৪ লাখ ৩০ হাজার। প্রতিবছর গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চাহিদা বাড়ে ট্রান্সফরমারের। আরইবির ট্রান্সফরমারগুলোর বেশিরভাগ ছোট ছোট সিলিন্ডারের মতো হওয়ায় সেখানে চুরির ঘটনা বেশি। এছাড়া নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডসহ (নেসকো) ঢাকার বাইরের বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোতেও হরহামেশা চুরির ঘটনা ঘটছে।
ঢাকার বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডেসকো ও ডিপিডিসিতে ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা কম বলে জানিয়েছেন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান। তিনি বলেন, ডিপিডিসির বেশিরভাগ ট্রান্সফরমার ২৫০ কেভিএর (ভোল্টের) উপরে। তাদের ট্রান্সফরমার সাধারণত সংরক্ষিত জায়গায় রাখা হয় এবং খুবই সুরক্ষিত। এছাড়া ভোল্টেজ বেশি হওয়ায় চোরের দল এগুলো চুরি করার সাহস পায় না। সাধারণ ছোট ছোট সাইজের ট্রান্সফরমার চুরি হয় বলে তিনি শুনেছেন।
আরইবির একজন প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, কতিপয় ট্রান্সফরমার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ী কম দামে চুরি করা ট্রান্সফরমার ক্রয় করে। পরে তারা এই ট্রান্সফরমারগুলোকে নতুন করে রং করে নিজেদের নামের নেমপ্লেট লাগিয়ে পুনরায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে সরবরাহ করে। অর্থাৎ একই ট্রান্সফরমারের জন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড দুবার টাকা দিতে হয়। সাভার, নবীনগর এবং বাইপাইল এলাকায় অবস্থিত কতিপয় ফ্যাক্টরিতে এসব চুরির ট্রান্সফরমার বেশি পাওয়া যায়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে কয়েকটি নতুন ট্রান্সফরমার সরবরাহকারী কোম্পানি লোকাল বাজারে ট্রান্সফরমার বিক্রয়ের অনুমতি পেয়েছে। অভিযোগ আছে-মোটা অঙ্কের ‘আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং’র মাধ্যমে কোম্পানিগুলো যাচাই-বাছাই ছাড়া আরইবিতে তালিকাভুক্ত হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী আরইবিতে তালিকাভুক্ত হতে হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করে তাদের গুণগতমান যাচাই করতে হয়। কিন্তু অভিযোগ, এক্ষেত্রে কোনো কিছু না করে তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ফলে সংযোগের অল্প সময়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোম্পানিগুলোর ট্রান্সফরমার। শুধু তাই নয় টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয়ের ক্ষেত্রেও আরইবি সিন্ডিকেট এসব কোম্পানিকে বেশি সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ আছে। নামমাত্র ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করে তাদের কার্যাদেশ দিচ্ছে।
ট্রান্সফরমার চুরির : অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রান্সফরমার চুরি বেড়েই চলেছে। এই অবস্থায় ট্রান্সফরমার রক্ষার জন্য গ্রাহকরা কোথাও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখছে। কোথাও বসিয়েছে পাহারা। কিন্তু কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ট্রান্সফরমার চুরি। দেশের ১৪টি স্থানে গত এক বছরে অন্তত ৪১৯টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এগুলোর দাম প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা। ট্রান্সফরমারগুলো পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) হলেও চুরি হওয়ার পর ভুগতে হয় সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের। বাধ্য হয়ে নতুন ট্রান্সফরমার কেনার টাকা তাদেরই দিতে হয়।
আরইবি সূত্রে জানা গেছে, ট্রান্সফরমার চুরি রোধে ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রচারপত্র বিলি ও মাইকিং পর্যন্ত করেছে। মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন কর্মকর্তা বলেন, ট্রান্সফরমার চুরিতে যারা জড়িত, তাদের বেশিরভাগই পেশাদার চোর। শুধু বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারই নয়, সুযোগ পেলে অন্যান্য জিনিসও চুরি করে চক্রটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২২ সালে পাঁচটি জেলা ও নয়টি উপজেলায় এক বছরে যে ৪১৯টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রাজবাড়ীতে চুরি হয়েছে ৯০টি ট্রান্সফরমার। এছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ে ৫৫টি এবং একই সংখ্যক ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জে। আর ৬০টি চুরি হয়েছে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে এবং রংপুরের বদরগঞ্জে হয়েছে ৫২টি।
এমনকি কোথাও কোথাও একই রাতে ছয়টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। এসব ট্রান্সফরমার ৫, ১০, ১৫, ২৫, ৩৭ ও ১০০ কিলো ভোল্ট (কেভি) ক্ষমতাসম্পন্ন। শক্তিভেদে এগুলোর দামও ভিন্ন।
ট্রান্সফরমারের মূল্যবান তামার কয়েলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকে। মূলত দামি কয়েলের কারণেই ট্রান্সফরমার চুরি হয়। চুরির ভয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের সরলিয়া গ্রামের একটি ট্রান্সফরমার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেটিও চুরি হয়ে যায় বলে জানান স্থানীয়রা। একই উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের পানিপুকুর তেগাছিয়া গ্রামের একটি ও নাউরিয়া পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছিল।
আইবি সূত্র জানায়, গ্রামে অধিকাংশ ট্রান্সফরমারই কৃষকদের জমিতে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়। তাই ট্রান্সফরমার চুরি হলে তাদেরই বেশি ক্ষতি হয়। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নিয়মানুযায়ী, প্রথমবার চুরি হওয়া ট্রান্সফরমারের জায়গায় নতুন ট্রান্সফরমার পুনরায় স্থাপন করতে গ্রাহককে অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করতে হয়। এরপর চুরি হলে ট্রান্সফরমারের পুরো মূল্যই দিতে হয় গ্রাহককে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ট্রান্সফরমার চুরি হলে সেচে ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা বলেন, বোরো চাষের মৌসুমে এভাবে সেচ পাম্প ও ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ায় সেচের কাজ ব্যাহত হয়। ফসল বাঁচাতে দ্রুত এসব ট্রান্সফরমার ও সেচ পাম্প কিনতে গিয়ে বেশি টাকা ব্যয় হয়। এতে কৃষকদের ভোগান্তির পাশাপাশি চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।
গত বছর চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গা উপজেলার চারটি গ্রাম থেকে দুই মাসেরও কম সময়ে অন্তত নয়টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। এর মধ্যে ২২ জানুয়ারি এক রাতেই চুরি হয় ছয়টি। এসব ঘটনায় দর্শনা ও আলমডাঙ্গা থানায় পৃথক চারটি মামলা হলেও এসব উদ্ধার বা চোর চক্রের সদস্যদের ধরতে পারেনি পুলিশ।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকেও গত বছর পল্লী বিদ্যুতের অনেক ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছিল। এই উপজেলার ছয়টি গ্রাম থেকে ৮টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে এক রাতে ২টি ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ায় খবর পাওয়া গেছে। গত বছর অক্টোবরে এক রাতে উপজেলার নিগুয়ারী ইউনিয়নের ভুসভুসিয়া ও সাধুয়া গ্রামে এই চুরির ঘটনা ঘটে। জানা যায়, সংঘবদ্ধ চোর চক্র ওই এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারের খোলস রেখে ভেতরের দামি তামার তার চুরি করে নিয়ে গেছে।
জানুয়ারিতে পটুয়াখালীর গলাচিপায় পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি করতে গিয়ে দুই ব্যক্তি বিদ্যুতায়িত হয়েছেন। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তাদের শরীরের নয় শতাংশ পুড়ে যায়। পুলিশ ও পল্লী বিদ্যুৎ সূত্র জানায়, গ্রামর্দন গ্রামে পল্লী বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার চুরি করতে যান ওই দুই ব্যক্তি। প্রথমে তারা একটি ১০ কেভির ট্রান্সফরমার চুরি করে নিয়ে যায়। পরে ওই রাতেই ২৫ কেভির ট্রান্সফরমারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে তারা আহত হন। পরে স্থানীয়রা তাদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।