বৃত্তি পেল ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী
প্রাথমিকের সংশোধিত ফল ২৯ ঘণ্টা পর
ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ ডিপিই’র * অভিন্ন কোড নম্বরেই বিভ্রান্তি * বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে অভিভাবক শিক্ষার্থীরা উদ্বিগ্ন -রাশেদা কে চৌধুরী
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার পুনঃযাচাই করা ফল প্রকাশ করা হয়েছে। বুধবার রাত সোয়া ১০টার পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
এর আগে মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ফল প্রকাশের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। পরে কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ায় ৪ ঘণ্টার মাথায় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে তা স্থগিত করা হয়।
এরপর প্রথমে আগের তৈরিকৃত ফল ফেলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি নতুন করে গোটা ফল তৈরি করা হয়। এ কাজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েটে) একজন অধ্যাপক উপস্থিত থেকে সহায়তা করেন।
সংশোধিত ফল প্রকাশ করে ডিপিই মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কারিগরি ত্রুটির কারণে ফলাফল পুনঃযাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
এ কারণে তাৎক্ষণিকভাবে তা স্থগিত করা হয়। পুনঃযাচাই শেষে স্থগিত করা ফল প্রকাশ করা হলো। এ অনিচ্ছকৃত ত্রুটির জন্য ডিপিই দুঃখ প্রকাশ করছে।
এদিকে কোমলমতি শিশুদের পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এভাবে তা বাতিলের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নজর কেড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেরও।
উভয় দপ্তর থেকে দ্রুত সঠিক ও সংশোধিত ফল প্রকাশের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যদিকে ফল নিয়ে এমন কাণ্ডে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
পাশাপাশি সচেতন মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এমনিতেই সুশীল সমাজের আপত্তি উপেক্ষা করে এই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া আগে থেকেই পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন আর ফল প্রণয়নের নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
এ অবস্থায় ফল তৈরিতে কারিগরি ত্রুটি সংশয়কে আরও ঘনীভূত করেছে। এমনকি মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের দপ্তর থেকে ফল ‘কেনাবেচার’ মতো গুজবও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে ফল প্রকাশের পর বাতিল নিয়ে। বিষয়টিকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ কাণ্ড এবং শিশুদের প্রতি ‘অবিচার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন সমালোচকরা।
তারা মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা গ্রহণ আর ফল প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে একদিকে খামখেয়ালিপনা ও তাড়াহুড়া, আরেকদিকে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পাওয়ার ঘটনা এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আর এসব কারণে এই ভুলের ঘটনা ঘটে। যার বলি হয় শিশুরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং স্থগিত করা উভয় ক্ষেত্রেই তাড়াহুড়ার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
এভাবে ভুল ফল প্রকাশ আর তা প্রত্যাহার দুটিই শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা তৈরি করেছে। বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় তারা ক্লান্ত এবং উদ্বিগ্ন।
যেহেতু প্রথম ফলে পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পাওয়ার তথ্য এসেছে, তাই এখন প্রকৃত অর্থে কেউ বৃত্তি পাওয়া সত্ত্বেও বঞ্চিত হয় কি না, তেমন সংশয় অবশ্যই তৈরি হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন এই ফল তৈরির ক্ষেত্রে প্রথমে আগের ডেটা বা ফল পুরোপুরি বাতিল করা হয়। এরপর বৃত্তি বণ্টনের নীতিমালা অনুযায়ী নতুন করে তথ্য আপলোড করে প্রোগ্রাম চালু করা হয়।
এরপরই নতুন ফল দেয় কম্পিউটার। তবে এ খাতে বৃত্তি বাবদ বরাদ্দ টাকা সামনে রেখে বৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকায় সংখ্যায় কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ ৮২ হাজার ৩৮৩ জন শিক্ষার্থীই বৃত্তি পেয়েছে।
যার মধ্যে মঙ্গলবারের ঘোষণা অনুযায়ী ৩৩ হাজার ট্যালেন্টপুলে আর ৪৯ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থী মনোনয়নে।
সঠিক কোড ব্যবহার করায় রেজিস্ট্রেশন ও রোল নম্বরও সংশোধন হয়। আগে পরীক্ষা না দেওয়া শিক্ষার্থী এবং তাদের রোল নম্বর বাদ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ফেল করা শিক্ষার্থীদের আলাদা চিহ্নিত করা হয়।
এরপর নীতিমালা অনুসারে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ডেটা ধরে কম্পিউটারকে ফল দিতে অর্ডার দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় চূড়ান্ত ফল। সূত্র জানায়, ভুল ফল তৈরির ক্ষেত্রে মূলত তাড়াহুড়া আর সময়স্বল্পতা মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।
এছাড়া উপজেলা যে কোড তৈরি করেছে, তা ডিপিইকে জানানো হয়নি। ফল তৈরির ক্ষেত্রে অভিন্ন কোড নম্বর লক্ষ্য করা গেলে তা পরিবর্তন করা যেত। আর এতে সফটওয়্যারের ‘মাথা’ নষ্ট হতো না।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিপিই-এর কম্পিউটার সেলের প্রধান প্রকৌশলী অনুজ কুমার রায় যুগান্তরকে বলেন, মূল সমস্যা হয়ে গেছে উপজেলা পর্যায়ে ফল তৈরির কারণে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার ফল তৈরি হতো উপজেলায়।
সেখান থেকে আসা ফল নিয়ে কাজ করে ডিপিই বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরি করত। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে ওই কাজ করলে তেমন ভুল হয় না। এক্ষেত্রে উপজেলা অনুযায়ী নতুন কোড দিয়ে ডেটা বিশ্লেষণ করার সময় পাওয়া যেত।
কিন্তু বিভিন্ন উপজেলা নিজস্ব পদ্ধতিতে কোড তৈরি করে ফল প্রস্তুত করে। এতে একই কোড একাধিক উপজেলা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পেয়ে গেছে। সেই কোড কিছু উপজেলার ক্ষেত্রে একটির সঙ্গে আরেকটি মিলে যাওয়ায় ভেতরের ডেটা প্রভাবিত হয়।
কম্পিউটার সেই ডেটা নিয়ে নিজের মতো কাজ করে। ফলে ঘটে গোলযোগ ও তথ্যগত ত্রুটি। তিনি আরও বলেন, এরপরও ভুলের ঘটনা যেখানে বা যাদেরই হোক না কেন, প্রধান হিসাবে এর দায় আমার ওপরই বর্তায়। তবে গোটা ত্রুটিই অনিচ্ছাকৃত। এজন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি।
জানা যায়, বৃত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে মূলত দুটি নিয়ম অনুসরণ করা হয়। একটি হচ্ছে, ৩৩ হাজার ট্যালেন্টপুল (মেধা) বৃত্তি, যা উপজেলা বা পৌরসভাভিত্তিক বণ্টন করা হয়। সারা দেশের মোট ছাত্রছাত্রীকে উপজেলা বা পৌরসভার শিক্ষার্থী সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়।
এরপর আনুপাতিক হারে বৃত্তির সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এতে যে ফল বা সংখ্যা আসে, সেটি সংশ্লিষ্ট উপজেলা বা পৌরসভার মোট ট্যালেন্টপুল বৃত্তি। এরপর ওই উপজেলা/পৌরসভার সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের মেধা তালিকা অনুযায়ী শ্রেষ্ঠদের এ বৃত্তি বণ্টন করা হয়।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ গ্রেডের বৃত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সারা দেশের উপজেলার ক্ষেত্রে মোট ইউনিয়ন আর পৌরসভার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড সংখ্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়। সারা দেশে যে কয়টি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আছে সেগুলোকে ৬ দিয়ে গুণ করা হয়।
এরপর প্রতি ইউনিয়ন (উপজেলা) ও ওয়ার্ডে (পৌরসভা) ৩ জন ছেলে ও ৩ জন মেয়েকে বৃত্তি দেওয়া হয়। যদি কোনো ইউনিয়নে ছেলে বা মেয়ের সংখ্যা এর কম থাকে, তাহলে বিপরীত লিঙ্গের শিক্ষার্থীকে বাছাই করা হয়।
যদি কোনো ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে কৃতকার্য শিক্ষার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে সেই বৃত্তি (৬টি) চলে যায়। সাধারণ গ্রেডে বৃত্তির ক্ষেত্রে এবার ৮ হাজার ১৪৫টি উপজেলা ইউনিয়ন/ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ৬টি (৩ জন ছাত্র ও ৩ জন ছাত্রী) হিসাবে ৪৮ হাজার ৮৭০টি বৃত্তি দেওয়া হয়।
এরপরও ৬৩০টি বৃত্তি অবশিষ্ট ছিল। সেগুলো থেকে প্রতিটি উপজেলা/থানায় ১টি করে মোট ৫১৩টি উপজেলা/থানায় ৫১৩টি সাধারণ বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। বাকিটা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর ঝিনাইদহ, রাউজান, চাঁদপুরসহ দেশের বেশ কয়েকটি উপজেলার একই কোড নম্বর ধরা পড়ে। এর ফলে সৃষ্ট গোলযোগ থেকে এক শিক্ষার্থীর তথ্য আরেকজনের রেজিস্ট্রেশন নম্বরে চলে যায়।
এতেই কেউ কেউ পরীক্ষা না দিয়েও বৃত্তি পেয়ে যায়। আবার ভালো পরীক্ষা দিয়েও বৃত্তি না পাওয়ার ঘটনা চিহ্নিত হয়। সূত্র জানায়, কতজন ফেল করা বা ভুলক্রমে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থী চূড়ান্ত ফলে বাদ পড়েছে কিংবা নতুন করে কতজন বৃত্তি পেয়েছে বা কতটি উপজেলার কোড একটির সঙ্গে আরেকটি মিলে গেছে, তা বের করা সম্ভব হয়নি।
প্রকৌশলী অনুজ কুমার রায় বলেন, বিষয়টি ম্যানুয়ালি শনাক্ত করতে হবে। আগামী সপ্তাহে এ তথ্য জানা যাবে।
প্রসঙ্গত, ফল প্রকাশে এমন ঘটনার কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে ডিপিই পরিচালক উত্তম কুমার দাশকে প্রধান করে মঙ্গলবারই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি প্রাথমিকভাবে কোডিং সমস্যার কারণেই ফলে ত্রুটির কারণ চিহ্নিত করেছে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি এই কমিটি।
মন্ত্রণালয় জানায়, বৃত্তি পরীক্ষার ফল ডিপিই’র ওয়েবসাইটে (www.dpe.gov.bd), মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট (www.mopme.gov.bd), স্থানীয়ভাবে বিভাগীয় উপপরিচালকের কার্যালয়, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় এবং উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় থেকে পাওয়া যাচ্ছে।
গত বছরের ২৮ নভেম্বর হঠাৎ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর প্রস্তুতির জন্য মাত্র ২৮ দিন সময় পায় মাঠ প্রশাসন। ৩০ ডিসেম্বর একযোগে সারা দেশে এই পরীক্ষা হয়। এতে ৫ লাখ ৩৯২ জন নিবন্ধন করলেও অংশ নেয় ৪ লাখ ৮২ হাজার ৯০৪ জন।