
প্রিন্ট: ০২ মার্চ ২০২৫, ০৬:০০ এএম
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্প
বিটুমিনের চেয়ে কম খরচে কংক্রিটের সড়ক
জ্বালানি ও পাথর কম লাগায় ৭৫ কিমি. সড়ক নির্মাণে ৭৫০ কোটি টাকা সাশ্রয়

মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে প্রকল্প গ্রহণ করে বিটুমিনের চেয়ে কম খরচে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করে উদাহরণ তৈরি করল সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর-সওজ।
টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার মহাসড়কের প্রায় ৭৫ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক মানের কংক্রিটে তৈরি করা হয়েছে। ছয়লেনের এই সড়ক তৈরিতে জ্বালানি তেল ও পাথরের ব্যবহার কম হওয়ায় কিলোমিটারপ্রতি প্রায় ১০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। অর্থাৎ ৭৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে সরকারের সাশ্রয় হয়েছে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা।
সওজের ‘সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২)’ প্রকল্প সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এযাবৎকাল সওজ বিটুমিন দিয়ে সড়ক তৈরি করেছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৬ মাস বর্ষাকাল থাকে। আর কয়েক মাস উচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে। বিটুমিনের সড়কগুলো ১০ থেকে ১৫ বছর টেকসই হয়। তবে বৃষ্টি, তাপ, অতিরিক্ত লোড নিয়ে যানবাহন চলাচলের কারণে ২ থেকে ৩ বছরে নষ্ট হয়ে যায় সড়কগুলো। তখন বড় ধরনের সংস্কার করতে হয়। সেসব সড়ক সচল রাখতে সওজকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়। আর কংক্রিটের সড়কের স্থায়িত্ব ২০ থেকে ২৫ বছর। এ সড়কের তেমন কোনো সংস্কার ব্যয় নেই। তবে ১০ থেকে ১৫ বছর পর এসব সড়ক কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত বা ফাটল হয়। তখন বিটুমিনের একটি প্রলেপ দেওয়া হয়। প্রতি ৫ বছর অন্তর এভাবে স্বল্প খরচ করে ৪০ থেকে ৫০ বছর ব্যবহার করা যায়।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিটুমিনের সড়কের জন্য বিটুমিন, জ্বালানি ও পাথর আমদানি করতে হয়। এসব আমদানি খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় বিটুমিনের সড়ক নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এজন্য এখন রড, বালু, সিমেন্ট ও পাথর দিয়ে তৈরি কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ সহজ হয়েছে। কেননা এই সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে বিটুমিনের সড়কের চেয়ে অনেক কম জ্বালানি খরচ হয়। পাথরের ব্যবহারও বিটুমিনের চেয়ে কম। নিজেদের দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে বেশির ভাগ কাজ করা যায়। এজন্য বর্তমান মহাসড়ক তৈরিতে বিটুমিনের চেয়ে কংক্রিটে খরচ কম হচ্ছে। এজন্য সওজ কম খরচে দীর্ঘস্থায়ী কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের চেষ্টা করছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, সওজ বহুদিন পর একটি ভালো সড়ক তৈরির কাজ শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী তিন দফা নির্দেশনা দেওয়ার পর তারা এটা শুরু করেছে। অবশ্য প্রথমে তারা বিটুমিনের সড়ক তৈরির কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু ওই সড়কে ১০ চাকার গাড়ি চলাচল করায় সাসেক-১ জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত অংশের বিটুমিনের সড়ক ভেঙে যাওয়ায় তারা বুয়েটের কাছে আসে। তখন তাদের আধুনিক প্রযুক্তি বা মেশিন ব্যবহার করে কংক্রিটের সড়ক তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়। শুরু থেকে এই কার্যক্রমের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। সওজের এই কাজটি অনন্য মাইলকফলক হয়ে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, জলাবদ্ধতা, ওভারলোড, যানজটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকায় বিটুমিনের সড়কগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য কংক্রিটের সড়কের কোনো বিকল্প নেই। উন্নত দেশগুলো আস্তে আস্তে কংক্রিটের সড়কে চলে যাচ্ছে। আমাদের মহাসড়কগুলো আর বিটুমিনে তৈরি করা ঠিক হবে না। অন্যান্য সড়কও স্থায়িত্বকাল বিবেচনা করে কংক্রিটে তৈরির কথা সরকারকে ভাবতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ম্যানুয়াল পদ্ধতির কংক্রিটের সড়কে ধুলার সৃষ্টি হতো এবং সড়ক উঁচু-নিচু হতো। মেশিন প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এখন আর এই ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশ কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের পথে এগিয়ে গেলে দেশও এগিয়ে যাবে। কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থায়িত্বকাল বিবেচনা করতে হবে।
সাসেক-২ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে বগুড়া পর্যন্ত অংশে ১৫ কিলোমিটার কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করেছে। এটা করা হয়েছে বাজার ও ব্যস্ততম সড়কে, যেখানে যানজট হয়। আর বগুড়ার মোকামতলা থেকে রংপুর পর্যন্ত ৮১ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৬০ কিলোমিটার কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রথম অংশের ১৫ কিলোমিটার কংক্রিটের সড়ক ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে করা হয়েছে। এজন্য এ অংশের সড়কে গাড়ি চলাচলে কিছুটা শব্দ হয়। আর পরের অংশের ৬০ কিলোমিটার কংক্রিট সড়ক নির্মাণে দেশে প্রথমবারের মতো মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে। এ কারণে ওই সড়কে আরামদায়কভাবে চলাচল করা যাচ্ছে।
জার্মানির অত্যাধুনিক মেশিনে এখনো ওই সড়কের বাকি অংশের কাজ চলছে। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তায় ১৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সওজ। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণে খরচ হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
২০১৭ সালে এই প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। আর ২০১৯ সালের জুনের কাজ শুরু করে সওজ। করোনার সময়ে কিছুদিন প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। বর্তমানে পুরোদমে কাজ চলছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদকাল রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে তৎপর রয়েছে সওজ।
সরেজমিন বগুড়ার মোকামতলা থেকে রংপুর পর্যন্ত অংশ ঘুরে দেখা গেছে, মেশিন ব্যবহার করে নির্মিত কংক্রিটের সড়কগুলো সমান। কোথাও উঁচু, নিচু নেই। গাড়ি চলাচলে কোনো শব্দও তৈরি করছে না। রংপুর অংশে মেশিন ব্যবহার করে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ কাজের স্থান পরিদর্শন করে মেশিনেরও উচ্চ শব্দ পাওয়া যায়নি।
দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রকৌশলী ও দায়িত্বপ্রাপ্তরা গর্ববোধ করছেন। তাদের অভিমত, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কারণে পরীক্ষামূলকভাবে কংক্রিটের দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সওজ। এ উদ্যোগে সফলতা পাওয়া গেছে। এ ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে মহাসড়কের নির্মাণ ব্যয় ও দুর্ভোগ অনেকাংশে হ্রাস পাবে। কেননা বিটুমিনের সড়ক নির্মাণের অল্প সময় পর ভেঙে যায়, তখন খানাখন্দের সৃষ্টি হয়। আবার কিছুদিন পর পর সড়ক সংস্কার করতে হয়। এতে মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। বিপুল অর্থের অপচয়ও হয়। আর কংক্রিটের সড়ক তৈরির পর দীর্ঘ সময় অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। সংস্কার ব্যয় নেই বললেই চলে।
সাসেক-২ প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক সন্তোষ কুমার রায় যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন সুবিধার কথা মাথায় রেখে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণকাজ শুরু করেছে সওজ। এর মধ্যে অন্যতম-বাংলাদেশে বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাস বৃষ্টিপাত হয়। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। বিটুমিন পানি এবং তাপের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আর ওভারলোডেড যানবাহন বিটুমিনের সড়কের মারাÍক ক্ষতি করে।
তিনি বলেন, বিটুমিনাস সড়কের আয়ুষ্কাল ১০ থেকে ১৫ বছর। জলাবদ্ধতা, ওভারলোডেড যানবাহন চালানোর কারণে নির্মাণের দুই-তিন বছর পর এটি মেরামত করতে হয়। অন্যদিকে কংক্রিট সড়কের আয়ুষ্কাল ২০ থেকে ২৫ বছর। এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচও খুবই কম। আর মহাসড়কগুলো কংক্রিটে তৈরি করলে খরচ সাশ্রয়ী হবে। অন্যান্য সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যয়ের এমন চিত্রও নাও মিলতে পারে। তবে স্থায়িত্বকাল একইরকম হবে।
তিনি আরও বলেন, কংক্রিটের সড়ক ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে নির্মাণ করলে পৃষ্ঠে রুক্ষতা সৃষ্টি হয়। যেটা যানবাহন চলাচলের সময় শব্দ ও ঝঁকুনি তৈরি করে। এজন্য এবার তাদের চীনা ঠিকাদার মেশিনের মাধ্যমে কংক্রিটের সড়ক তৈরির কাজ করছে। এই সড়কে আরামদায়কভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারছে।
সাসেক-২ প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী ওয়ালিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিটুমিনের সড়কের চেয়ে কংক্রিটের সড়ক স্থায়িত্বকাল বেশি। বিটুমিনের সড়ক ১ থেকে ২ বছরেই অকেজো হয়ে পড়ছে। আর কংক্রিটের সড়ক ১৫ থেকে ২০ বছরেও কিছু হবে না।
তিনি বলেন, আগে বিটুমিনের সড়কের চেয়ে কংক্রিটের সড়কের নির্মাণ ব্যয় বেশি ছিল। বর্তমানে বিটুমিনের সড়কের চেয়ে কংক্রিটের সড়কের নির্মাণ ব্যয় কম হচ্ছে। এই প্রকল্পের ১৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৭৫ কিলোমিটার কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি ১১৫ কিলোমিটার বিটুমিনের সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ করতে গিয়ে এবার আমরা এমন চিত্র দেখতে পেলাম।
তিনি আরও বলেন, কংক্রিটের সড়কের এতদিনের সমস্যা ছিল উঁচু, নিচু হয়ে যেত। এ কারণে যানবাহন লাফাত এবং শব্দ হতো। এবার মেশিনের মাধ্যমে কংক্রিটের সড়ক তৈরি করায় সে সমস্যার সমাধান হয়েছে। এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা আমাদের কাছে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের মেশিন চেয়ে চিঠি লিখছে। কিন্তু আমাদের প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় আমরা কাউকে সহযোগিতা করতে পারছি না।