Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আমদানি

যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করেও দিতে হচ্ছে ‘হোয়েস্টিং চার্জ’

ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা গচ্ছা, তবু অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ

Icon

শহিদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করেও দিতে হচ্ছে ‘হোয়েস্টিং চার্জ’

হোয়েস্টিং (উত্তোলন) চার্জের নামে কিছু কিছু আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এসব আমদানি পণ্য খালাস বা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বন্দরের কোনো যন্ত্রপাতি বা ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার না হওয়া সত্ত্বেও প্রতি টনে নির্ধারিত হারে টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

বিভিন্ন সময়ে এর প্রতিবাদ এবং বাড়তি টাকা আদায় বন্ধ করার দাবি জানানো হলেও তা আমলেই নিচ্ছে না চবক। এ অবস্থায় আমদানিকারকদের একই পণ্য খালাসের জন্য দুদফায় চার্জ দিতে হচ্ছে। ‘এটিকে একই গরু দুবার জবাই করার’ সঙ্গে তুলনা করছেন ভুক্তভোগীরা। এভাবে বাড়তি চার্জ দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে আমদানিকারকদের ওপর।

চট্টগ্রামের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ছাড়াও বন্দর ব্যবহারকারী আমদানিকারকরা বলছেন, হোয়েস্টিং চার্জের নামে অতিরিক্ত এই অর্থ আদায় বেআইনি। আলোচ্য পণ্যের ক্ষেত্রে চবক প্রতি টনে ৩০০ টাকা করে অতিরিক্ত চার্জ আদায় করছে। একেকটি কনটেইনারে সাধারণত ২৫ টনের ওপরে পণ্য থাকে। সে হিসাবে প্রতি কনটেইনারের জন্য সাড়ে সাত হাজার টাকা অতিরিক্ত হোয়েস্টিং চার্জ গুনতে হচ্ছে আমদানিকারককে। ১০০ টন পণ্যের জন্য অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা! এভাবে হাজার হাজার টন পণ্যের বিপরীতে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ট্যারিফভুক্ত চার্জই বন্দর নেয়। বাড়তি বা অতিরিক্ত কোনো চার্জ নেওয়া হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘যেখানে প্রধানমন্ত্রী ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’র কথা বলছেন, ব্যবসা ব্যয় বা খরচ কমাতে বলছেন, সেখানে বন্দর কর্তৃপক্ষ একই পণ্যের জন্য চার্জের নাম বদল করে দুবার টাকা আদায় করছে। এটা অযৌক্তিক, বেআইনি ও ব্যবসায়ীদের ওপর জুলুম।’ তিনি বলেন, ‘বন্দরের কোনো ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার করা হবে না, অথচ চার্জ দিতে হবে-এটা গায়ের জোরের কথা। আমার পণ্য আমি ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার না করে যদি নিতে পারি, তাতে বন্দর কেন ইক্যুইপমেন্ট চার্জ নেবে। এটা হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনে উচ্চপর্যায়ে কথা বলব।’

আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী সূত্রগুলো জানান, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আমদানি-রপ্তানি পণ্য লোড-আনলোড, খালাস, কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও ইয়ার্ডে রাখাসহ নানা কারণে ভিন্ন ভিন্ন নামে চার্জ আদায় করে থাকে। স্টোর রেন্ট, হোয়েস্টিং চার্জ, শিফট অন চার্জসহ বিভিন্ন নামে এসব চার্জ বন্দরকে দেন ব্যবসায়ীরা। তবে এসব চার্জ ট্যারিফভুক্ত। কিন্তু ট্যারিফভুক্ত না থাকার পরও বন্দর নিজস্ব ক্ষমতা বলে সার্কুলার দিয়েই বেআইনিভাবে কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে হোয়েস্টিং চার্জ আদায় করছে বলে তাদের অভিযোগ।

সূত্র জানায়, প্লাস্টিক দানা, কাগজ, টাইলসসহ বিভিন্ন পণ্য বস্তা বা প্যাকেটজাত করে কনটেইনারে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কাতার, ওমানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। ২০ ফুট কিংবা ৪০ ফুটের এফসিএল (ফুল কনটেইনার লোড) বা এলসিএল (লুজ কনটেইনার লোড) কনটেইনারে এ ধরনের পণ্য আসে। পণ্যের বস্তা বা প্যাকেটগুলো কনটেইনারের ভেতর নির্দিষ্টসংখ্যক প্যালেটে রাখা হয়। তাই এসব পণ্যকে ‘প্যালেট কার্গো’ও বলা হয়ে থাকে। বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার নামার পর সেখান থেকে প্যালেট ভেঙে লেবার (শ্রমিক) দিয়ে বস্তা বা প্যাকেটজাত পণ্য ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে তোলা হয়। বন্দর দিয়ে প্রতিদিন এ ধরনের শত শত টন পণ্য আমদানি হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে একজন আমদানিকারক একটি ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য শিফট অন চার্জসহ অন্যান্য চার্জের পাশপাশি ৩ হাজার ৮০০ টাকা লেবার চার্জ দেন চট্টগ্রাম বন্দরকে। এই চার্জ দিয়েই বস্তাভর্তি পণ্য বা প্যালেট কার্গো বন্দর থেকে ডেলিভারি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যেত অতীতে। কিন্তু বছর দেড়েক আগে একই পণ্যের ক্ষেত্রে চবক প্রতি টনে অতিরিক্ত ৩০০ টাকা করে হোয়েস্টিং চার্জ আরোপ করে। আর এতেই ব্যবসায়ীরা হতবাক হন।

তারা বলছেন, ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার করে এসব পণ্য কনটেইনার থেকে খালাস বা গাড়িতে উত্তোলন করতে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যন্ত্রের আঘাতে বস্তা ছিঁড়ে যায়। পণ্য পড়ে যায়। তাই লাখ লাখ টাকা দিয়ে আনা এসব পণ্য তারা নষ্ট করতে চান না। সে জন্যই ম্যানুয়ালি শ্রমিক দিয়ে পণ্য গাড়িতে উত্তোলনের পথ বেছে নেন তারা। এক্ষেত্রে বন্দরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করলেও তার চার্জ আমদানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন আমদানিকারক ও তাদের প্রতিনিধিরা। এর আগে একই পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০০২ সালের ৯ এপ্রিল প্রদত্ত এক চিঠিতে স্পষ্ট বলেছে, এফসিএল কনটেইনারে কোনো পণ্য প্যালেট আকারে আনা হলেও যদি এই পণ্য ম্যানুয়ালি হ্যান্ডেল করে ডেলিভারি নেওয়া হয় এবং এতে যদি বন্দরের কোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা না হয়, তবে সে ক্ষেত্রে হোয়েস্টিং চার্জ হবে না। তৎকালীন টার্মিনাল ম্যানেজার আহসানুল কবির এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। তৎকালীন পরিচালক (পরিবহণ) এই সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু এখন নিজেদের দেওয়া এই চিঠি নিজেরাই অগ্রাহ্য করছে বন্দর। এ ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে বছর দেড়েক আগে থেকে হোয়েস্টিং চার্জ আদায় করা হচ্ছে।

এদিকে সর্বশেষ ২৪ নভেম্বর নতুন একটি সার্কুলার দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ আলোচ্য পণ্য আনার ক্ষেত্রে আমদানির কাগজপত্র তথা বিএল (বিল অব লেডিং) ও আইজিএম (ইমপোর্ট মেনিফেস্ট জেনারেল) এ ‘প্যালেট কার্গো’ ঘোষণা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। অন্যথায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার কথাও বলেছে চবক। সূত্র জানায়, মূলত হোয়েস্টিং চার্জ আদায়ের বিষয়টিকে আরও পাকাপোক্ত করতেই এমন সার্কুলার জারি করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এ অবস্থায় প্রতিকার দাবি করে হোয়েস্টিং চার্জ আদায় না করার সিদ্ধান্ত সংবলিত বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিবহণ বিভাগের ২০০২ সালের ৯ এপ্রিলের চিঠি আমদানিকারকের প্রতিনিধিরা পরিবহণ বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থাপন করেন। কিন্তু এ চিঠি আমলে না নিয়ে তারা সেখানে লিখে দেন-‘এটা পূর্বের সার্কুলার যা আমলযোগ্য নহে, অথবা বাতিল করা হল ২৪/১১ সার্কুলার দ্বারা।’

চট্টগ্রামে এই খাতের বড় ব্যবসায়ী, চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এক্সেসরিজ গ্রুপের উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইকবাল যুগান্তরকে বলেন, ‘আমদানি পণ্য নিয়ে কনটেইনার আসার পর একবার লেবার চার্জ চট্টগ্রাম বন্দরকে দিচ্ছি। সেই পণ্য যদি ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার ছাড়াই আমি লেবার দিয়ে খালাস বা উত্তোলন করতে পারি সেক্ষেত্রে বন্দর কেন দ্বিতীয় দফায় হোয়েস্টিং চার্জ নেবে। বন্দরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলেই এটা নিতে পারে।

তাছাড়া এটা ট্যারিফভুক্ত কোনো চার্জ নয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই সার্কুলার দিয়ে ব্যবসায়ীদের বাড়তি চার্জ দিতে বাধ্য করছে। যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করা সত্ত্বেও এজন্য হোয়েস্টিং চার্জ চাপিয়ে দেওয়াটা এক ধরনের জুলুম। আমরা এর থেকে নিস্তার চাই।’ এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বস্তা ও প্যাকেটজাত হয়ে প্লাস্টিক দানা, কাগজ, টাইলস ছাড়াও আরও অনেক ধরনের হাজার হাজার টন পণ্য আমদানি হয়। এর বিপরীতে বন্দর হোয়েস্টিং চার্জের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের পকেট থেকেই বিপুল অঙ্কের এই অর্থ গচ্ছা যাচ্ছে। অন্যদিকে এ কারণে উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যের আদমানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নৌ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘এক-দেড় বছর আগে থেকেই বন্দর কর্তৃপক্ষ প্যালেট কার্গো খালাসের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ৩০০ টাকা করে হোয়েস্টিং চার্জ আদায় করছে। বন্দরের কোনো ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার না করেও এই টাকা দিতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। বেআইনি এই চার্জ আদায় বন্ধের দাবিতে আমি ফাইট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছি না। সবাইকে এ জন্য সোচ্চার হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু প্যালেটে করে আসা বস্তাজাত বা প্যাকেটজাত পণ্যের ক্ষেত্রেই নয়, মেশিনারিজের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি (হাইস্টার) ব্যবহার না হলেও হোয়েস্টিং চার্জ আদায় করছে বন্দর। তারা এটাও করতে পারে না।’

বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘বন্দর কোনো ক্ষেত্রেই বাড়তি বা অতিরিক্ত চার্জ নেয় না। শুধু ট্যারিফভুক্ত চার্জগুলোই নেয়। যা সবার জন্য প্রযোজ্য। তাছাড়া কোনো ক্ষেত্রে আমদানিকারক পণ্য খালাস বা লোড-আনলোডিংয়ের ক্ষেত্রে বন্দরের ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার না করলেও তাকে চার্জ দিতে হবে। কারণ, এ কাজের জন্য তো ইক্যুইপমেন্ট ও লেবার রেডি করে রেখেছে বন্দর।’ চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহণ) এনামুল করিমও একই কথা বলেন। তবে তিনি বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়টি আমাকে খতিয়ে দেখতে হবে।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম