মধ্যম আয়ের পথে বাংলাদেশ
অবকাঠামো উন্নয়নে বিপ্লব
ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাত পোহালেই উন্নয়নের আরও একটি মাইলফলকে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের প্রথম পাতাল রেল নির্মাণকাজ শুরু হবে বৃহস্পতিবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন।
আবার এ মাসেই দুয়ার খুলবে চট্টামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলের। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৫ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া আগামী জুনে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে। অক্টোবরে চালু হতে যাচ্ছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল।
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় মাত্র ৩৫ দিন আগে দেশবাসী যুক্ত হয়েছেন মেট্রোরেলের সঙ্গে। পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুসহ ছোট-বড় একশ ব্রিজ ও একশ সড়ক-মহাসড়ক চালুর মধ্য দিয়ে দেশে যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটেছে।
অবকাঠামো উন্নয়নের ইতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করলেও বর্তমানে পুনরায় অগ্রগতি শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে বেড়েছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে চাপমুক্ত করবে। এছাড়া সোমবার মধ্যরাতে দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। দেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালীর কারণে এই ঋণ দিয়েছে বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অবকাঠামো ও অর্থনীতির অগ্রযাত্রা প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, শুধু অবকাঠামো নয়, অর্থনীতিতেও অগ্রগতি হয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অর্থনীতির অগ্রগতির ধারাবাহিকতা ছিল। করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিছুটা সমস্যা তৈরি করেছে।
তবে এখন অগ্রগতি আবারও ফিরে আসছে। তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন অনেক বেশি হয়েছে। আর এ উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতিও জড়িত। পদ্মা সেতু চালুর পর এর সুফল অর্থনীতিতে আসছে। তবে এই উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে হলে কিছু সমস্যা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। যেমন দুর্নীতি, অর্থ পাচার, অপচয় ও ব্যাংকিং খাতের সমস্যা। এ সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে মধ্যম আয়ের দেশ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং উন্নত দেশে পৌঁছানোর মতো ভিশন অর্জন সহজ হবে।
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, গত ১৫ বছরে উন্নয়নের দিক থেকে অনেক এগিয়েছে দেশ। পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে গ্রামের রাস্তাঘাটও পাকা হয়েছে। যা ২০ বছর আগেও দেখা যায়নি। এত বেশি উন্নয়ন বিশ্বের অনেক দেশে হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পৃক্ততা আছে। একই সময়ে ৫ বছর অন্তর বেড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কিন্তু করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধ সমস্যা না হলে প্রবৃদ্ধি এখন ৮ শতাংশের ওপর বিরাজ করত। তবে উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র্য হার কমেছে এবং একই সময়ে বেড়েছে বৈষম্য। সমাজের একশ্রেণির লোকের কাছে প্রচুর সম্পদ গেছে। এই বৈষম্য কমিয়ে আনাই এখন চ্যালেঞ্জ হবে। এছাড়া গুণগত শিক্ষার মান ও দক্ষ জনবল সেভাবে গড়ে ওঠেনি। উন্নয়নের গতি ধরে রাখতে হলে শিক্ষায় গুণগত মান ও দক্ষতা গড়ে তুলতে হবে।
অবকাঠামো উন্নয়ন : ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনায় পাতাল রেল নির্মাণ হবে। পূর্বাচল সেক্টর ৪-এ নির্মাণকাজের উদ্বোধনের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। বিমানবন্দর-কমলাপুর এবং পূর্বাচল-নতুন বাজার-রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ রুটে কোট ২৩৮ কিলোমিটারের পাতাল ও উড়াল এমআরটি লাইন-১ নির্মাণ হবে এ প্রকল্পের আওতায়।
বিমানবন্দর রুট (বিমানবন্দর-কমলাপুর), এখানে ১২টি স্টেশন নিয়ে পাতাল রেল হবে। আর দ্বিতীয় অংশে পূর্বাচল রুট (নতুন বাজার থেকে রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ ডিপো), সেখানে ৯টি স্টেশনসহ উড়াল রেল হবে। এই স্টেশনগুলোর মধ্যে সাতটি স্টেশন উড়াল এবং বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসাবে নতুন বাজার ও নর্দ্দা স্টেশন পাতাল অংশে থাকবে। বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর যেতে মাত্র ২৪ মিনিট সময় নেবে।
১২টি পাতাল স্টেশনে ও সাতটি উড়াল স্টেশনে বিরতিসহ নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল যেতে ২০ মিনিট সময় লাগবে। এর নির্মাণ ব্যয় হবে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা এবং আগামী ২০২৬ সালে শেষ হবে। চলতি বছরের অক্টোবরে উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের আদলে হচ্ছে এর নির্মাণ।
এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর সারা দেশের ৫০টি জেলায় ২০২১ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার সম্মিলিত দৈর্ঘ্যরে ১০০টি সড়ক ও মহাসড়ক একসঙ্গে উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া গত ৭ নভেম্বর সারা দেশের ২৫টি জেলায় ১০০টি সেতু চালু করা হয়। মাত্র দেড় মাসের মাথায় সারা দেশে যোগাযোগে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৯টি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। অন্যগুলোর মধ্যে তিনটি কাজ ৮৭ শতাংশের ওপরে এবং পাঁচ প্রকল্পের কাজ অর্ধেকের বেশি শেষ হয়েছে।
এদিকে গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হয়। সেতুর সুফল অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া বাস্তবায়িত হচ্ছে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প। শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয় ২৬ হাজার ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এছাড়া ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৫১ শতাংশ।
এদিকে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আগামী জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয় ২৯ হাজার ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাগেরহাটে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৭৮.৫৩ শতাংশ। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। আর কক্সবাজার ও রামু-মিয়ানমারের কাছের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প। গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত এর ব্যয় হয় ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
মেগা প্রকল্প ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় রাস্তা, সড়ক-মহাসড়ক এবং ছোট-বড় ব্রিজ গেল কয়েক মাসে ২০০ উদ্বোধন করা হয়েছে।
মধ্যম আয়ের দেশের পথে : অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ পা রাখছে মধ্যম আয়ের দেশে। এ অগ্রযাত্রা বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক। এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সংক্রান্ত একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাণিজ্য সহায়তা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া সম্ভাব্য প্রভাব চিহ্নিত, প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগ, স্থানীয় বাজার উন্নন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ ও ট্যারিফ যৌক্তিকরণ এবং বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করতে জাতীয় কমিটির অধীনে গঠন করা হয়েছে সাতটি সাবকমিটিও। সে কমিটিগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করছে।
অর্থনীতিতে অগ্রগতি : করোনা এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এর আগে দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। ২০২০ সালে দারিদ্র্য হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ ও অতি দারিদ্র্যের হার কমে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু করোনার নেতিবাচক প্রভাবে সাময়িক হলেও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়। পরবর্তীকালে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্জন হয়। কিন্তু চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, গম, ভোগ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। বেড়ে যায় বিশ্ববাজারে পরিবহণ ব্যয়ও। তবে আশার বাণী হচ্ছে, এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে প্রবাসীদের আয় এবং রপ্তানি। যা আগামী দিনের অর্থনীতির নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। পাশাপাশি সোমবার রাতে আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা চাপ কমবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।