দুর্নীতি মামলার আসামিরা সক্রিয়
রাজউকে জালিয়াত চক্রের সন্ধান
প্রবাসী মালিকদের ছবি পালটিয়ে প্লট বিক্রি, রাজউকের সুনাম ক্ষুণ্ন করছেন দলবাজ দুর্নীতিগ্রস্তরা * মূল হোতা জাফর সাদেককে ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
২০০১ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে মোট ১৫ হাজার প্লট বরাদ্দের দরখাস্ত আহ্বান করা হয়।
এর মধ্যে আটচল্লিশোর্ধ্ব বয়সি প্রবাসী বাংলাদেশিদের বরাদ্দ দেওয়া হয় প্রায় তিন হাজার প্লট। অর্থসংকটের কারণে তখন এককালীন ডলারে মূল্য পরিশোধে লটারি ছাড়াই তাদের প্লট দেয় রাজউক।
২০০৩ সালে এসব প্লটের বরাদ্দপত্র হাতে পান প্রবাসীরা। কিন্তু হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে তাদের প্লট বুঝে নেননি। আবার বরাদ্দ পাওয়া অনেক প্রবাসী মালিক প্লট বুঝে পাওয়ার আগে মারাও গেছেন।
মালিক এখনো প্লট বুঝে নেননি এবং মারা গেছেন, জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের অন্তত অর্ধশত প্লট বিক্রি করে দিয়েছে রাজউকে গড়ে ওঠা শক্তিশালী একটি চক্র। ফাইল গায়েব করে, মালিকের ছবি পালটে এসব প্লট বিক্রি করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন চক্রের সদস্যরা। চক্রের হোতা রাজউকের অফিস সহকারী জাফর সাদেককে ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ এবং যুগান্তরের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
এদিকে জালিয়াতচক্রের দুই সদস্য বাশার শরিফ ও সাইফুল্লাহ চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। দুদকের তদন্তে তাদের জালিয়াতির সত্যতা পাওয়ায় আদালতে অভিযোগপত্রও দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন। এরপরও তারা দমে যাননি। দাপটেই যাতায়াত করেন রাজউক কার্যালয়ে। জালিয়াতিতে তারা এখনো সক্রিয় থাকলেও রাজউকের ঊর্ধ্বতনরা তাদের কাছে অসহায়। কারণ তারা রাজউক শাখা শ্রমিক লীগের নেতা।
জালিয়াতচক্রের সন্ধান পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, রাজউকের অনেক ফাইল গায়েব হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে। সাধারণ ডায়ারিও (জিডি) আছে। মামলা ও জিডির পরিপ্রেক্ষিতে রাজউকের অফিস সহকারী জাফর সাদেককে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার কাছ থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কিছু তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
আলাপকালে গোয়েন্দা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের কথা স্বীকার করে জাফর সাদেক বলেন, ‘আমি প্লট জালিয়াতিতে জড়িত নই। কেউ প্লট বিক্রি করতে চাইলে মধ্যস্থতা (দালালি) করেছি। এটা অন্যায় নয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গ্রাহকরা ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য এলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সহজে কাজ হয় না। এ কাজে গ্রাহকদের সহযোগিতা করলে ভবনের তলাভেদে চার থেকে ১৬ লাখ টাকা পাওয়া যায়। এই টাকার ভাগ বিভিন্ন স্তরে দিতে হয়।’
ডিবি সূত্রে জানা যায়, রাজউকের প্লট জালিয়াতির অভিযোগে ১৬ ডিসেম্বর ‘চক্রের হোতা’ সংস্থাটির অফিস সহকারী ও রাজউক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি জাফর সাদেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেওয়া হয়। টানা দুই দিনের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি রাজউকের নথি গায়েব, প্লট ও নকশা জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দেন। কারা ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৭ বছর রাজউকের অ্যাস্টেট শাখায় কর্মরত থেকে জালিয়াতচক্রে সক্রিয়, সেই তথ্যও দেন তিনি। ডিবি তথ্য পেয়েছে, এই শাখায় দীর্ঘদিন কাজ করেন গিয়াস, উজ্জ্বল, মাসুদ ও সার্ভেয়ার সাত্তার। চক্রের সদস্যদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। মাসুদ রেকর্ডকিপার পদে কর্মরত থাকলেও তিনি মূলত ডিলিং অ্যাসিস্ট্যান্টের (ফাইলে প্রাথমিক নোট দেওয়া ও ফাইল ওঠানামা করানো) কাজ করেন। সেখানে তার প্রভাব রয়েছে।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে জালিয়াতচক্রের অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়েও মুখ খুলেছেন জাফর সাদেক। তিনি নিজেও অন্তত অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বলে স্বীকার করেছেন। আফতাবনগরে তিন কাঠা জায়গার ওপরে তিনি গড়ে তুলেছেন আটতলা বাড়ি। শান্তিনগরে স্ত্রীর নামে কিনেছেন ১৬৬০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট, পুরানা পল্টনের গাজী শপিং কমপ্লেক্সে দুটি বাণিজ্যিক স্পেস, মিরপুরের অভিজাত রাকিন সিটিতে ফ্ল্যাট রয়েছে তার। টয়োটা প্রিমিও এবং এলিয়ন ব্র্যান্ডের দুটি প্রাইভেট কারও রয়েছে তার। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা রয়েছে। জাফর সাদেকের এসব সম্পদের খোঁজে বুধবার সরেজমিনে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি টিম। অভিযানকালে আফতাবনগরে তার আটতলা বাড়ি এবং শান্তিনগরে ফ্ল্যাট থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। অন্যান্য সম্পদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তবে দুদকের অভিযান টের পেয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এমনকি দুদক কর্মকর্তারা বারবার তার মোবাইল ফোনে কল করেও তাকে পাননি। দুদকের সহকারী পরিচালক নেয়ামুল আহসান গাজীর নেতৃত্বে একটি টিম অভিযানকালে রাজউকের প্রধান কার্যালয়, শান্তিনগর ও আফতাবনগরে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে। দুদক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশন যৌথভাবে অনুসন্ধান চালালে এই চক্রের সব সদস্যের অবৈধ সম্পদের পাহাড় পাওয়া যাবে। জাফর সাদেকের ওপর নজরদারি করতে গিয়ে গোয়েন্দারা আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পেরেছেন, রাজউকের জনৈক কর্মকর্তা শাহীনের সঙ্গে এই চক্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিদিন ওই কর্মকর্তা এই চক্রের বেশকিছু ফাইলে সই করে লক্ষাধিক টাকা উৎকোচ পান। আর এসব ফাইলের কাজ করিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন চক্রের সদস্যরা। সন্ধ্যার পর তারা নগরীর বিজয়নগর ও কাকরাইলের দুটি হোটেলে মদের আসরে যোগ দেন।
ডিবির দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চক্রের সদস্যরা ফাইল গায়েব, ফাইলে আবেদনকারীর ছবি পরিবর্তন করে প্লট বিক্রিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। এই চক্রের সক্রিয় সদস্য সংস্থাটির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবুল বাশার শরিফ। কাজ করেন বেঞ্চ সহকারী পদে (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন কোনো ফাইলে সই করেন, তখন ফাইল এগিয়ে দেওয়া, পাতা উলটে ধরার কাজ)। ফলে ফাইলগুলো তার নখদর্পণে থাকে। এই সুযোগে কিছু কিছু ফাইল টার্গেট করে সেগুলো গায়েব করেন। এরপর সংশ্লিষ্ট ফাইল খুঁজে দেওয়ার নাম করে মালিকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। ঘুস না দিলে বছরের পর বছর ঘুরেও ওই ফাইলের হদিস পান না মালিকরা। ফাইল গায়েবের অভিযোগে বাসারের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে রাজউক প্রশাসন। এরপর দুদকও তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। বিভাগীয় ও দুদকের মামলার পর তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপরও তিনি নিয়মিত রাজউক কার্যালয়ে যাতায়াত করেন। চক্রের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলে তিনি এখনো সক্রিয়। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে তিনি নির্বিঘ্নে দাপট দেখান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফাইল গায়েবের ঘটনা রাজউকে নতুন কিছু নয়। তবে এই চক্রের নতুন কৌশল হচ্ছে ফাইল গায়েব করে আবেদনকারীর ছবি পালটে প্লট বিক্রি করে দেওয়া। আর এক্ষেত্রে চক্রের প্রধান টার্গেট প্রবাসী প্লট মালিক। চক্রের সদস্যরা রেকর্ড শাখায় সন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হন বরাদ্দ পেয়ে এখনো কারা প্লট বুঝে নেননি। যারা এখনো প্লট বুঝে নেননি, তারা আর দেশে আসবে না, কিংবা মারা গেছেন ভেবে ওইসব প্লটের ফাইল গায়েব করে দেন। এরপর আবেদনপত্রে মালিকের ছবি বদলে ভুয়া মালিক সাজিয়ে প্লট বিক্রি করে দেন। এক্ষেত্রে আবেদনে মালিকের জটিল সই থাকলে (যদি জাল করা অসম্ভব হয়) চিকিৎসকের ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিল করেন। তাতে দুর্ঘটনায় হাতের আঙুল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সই করতে অপারগতার কথা উল্লেখ করা হয়। এরপর ভুয়া মালিকের টিপ-সইয়ের মাধ্যমে প্লট বিক্রির দলিল সম্পন্ন করা হয়। এই চক্রের সঙ্গে কারাবন্দি আলোচিত গোল্ডেন মনিরেরও চরম সখ্য ছিল। মনির এবং এই চক্রের যোগসাজশে এ ধরনের অর্ধশত প্লট বেচাকেনা করে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩০ প্লট গোল্ডেন মনির নিজেই নামে-বেনামে ক্রয় করেন বলে জানা গেছে।
ফাইল গায়েবকারী চক্রের শিকার হন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক বাংলাদেশি নাগরিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, পূর্বাচলে ১৪ নম্বর সেক্টরের ৩০৫ নম্বর রোডে তিনি প্লট বরাদ্দ পান। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি আর দেশে আসেননি। প্লটটি আত্মীয়কে দলিল করে দিতে চাইলে জানতে পারেন তার ফাইলটি গায়েব হয়ে গেছে। পরে বেঞ্চ সহকারী বাশারকে মোটা অঙ্কের ঘুস দিয়ে সেই ফাইল উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
জানা যায়, ফাইল গায়েবের বিভাগীয় তদন্ত করতে গিয়ে রাজউক জানতে পারে ফাইল গায়েবকারী চক্রের আরেক সদস্য সংস্থাটির ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সাইফুল্লাহ চৌধুরী। তার দপ্তর থেকেও বাশার শরিফ ফাইল গায়েব করে লুকিয়ে রাখতেন। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের একাংশে বলা হয়, রাজউক কর্মকর্তা ও কর্মচারী চাকরি বিধিমালার ২০১৩-এর ৩৭(চ) অনুযায়ী বিষয়টি চুরি বা প্রতারণার শামিল। এ কারণে তাকে চুরি বা প্রতারণার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে রাজউক বাশার শরীফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা (নম্বর ১০/২০২০) দায়ের করে।
জানতে চাইলে আবুল বাশার শরিফ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি সাসপেন্ডে আছি। আমার চাকরিবাকরি নেই। ঘুরে বেড়াই। রাজউকে আমার কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তিও নেই। চাকরি না থাকলে সেভাবে আর কেউ গ্রহণ করে না।’ আপনি শ্রমিক লীগ নেতা, সেই প্রভাবে এখনো রাজউকে দাপটে আছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারি দল করি। সরকার আমার। আওয়ামী লীগ আমার। আমরা যদি প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখাই, তাহলে দেশ থাকে? বিশেষ করে আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। রয়েল ডিস্ট্রিক্টের লোক আমি। আমরা আইনের বাইরে একটা কিছু করলে আমাদের ইজ্জত থাকে? আমাদের ইজ্জতের দাম আছে। আর বর্তমানে রাজউকে দুর্গতি ও একটা ভয়াবহতা চলছে।’ সাইফুল্লাহ চৌধুরীর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।