Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অভিযোগের পাহাড় দুদকের কাজ সীমিত

বেপরোয়া দুর্নীতির দুষ্টচক্র

২০২২ সালে জমা হওয়া ১৯ হাজার অভিযোগের মধ্যে ৯৬% আমলে নেওয়া হয়নি

Icon

মাহবুব আলম লাবলু

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বেপরোয়া দুর্নীতির দুষ্টচক্র

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাহাড়সম অভিযোগ জমা পড়েছে। স্বাধীন সংস্থাটিতে ২০২২ সালে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর ৬১ ভাগ সরাসরি দুদক কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন ভুক্তভোগী মানুষ। সাত উৎস থেকে আসা অভিযোগের শতকরা ৯৬ ভাগই আমলে নেওয়া হয়নি।

অভিযোগের পরিসংখ্যানই স্পষ্ট করে দিচ্ছে-দুর্নীতি দমনে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নানা হুঁশিয়ারি, হুমকিধমকি কাজে আসছে না। দেশের মানুষকে জাঁতাকলের মতো চেপে ধরেছে দুর্নীতির দুষ্টচক্র।

সক্রিয় এ চক্রকে দমাতে প্রতিষ্ঠানটি তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।

দুদক আইনে মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে শত্রুতার কারণে বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অনেকে কমিশনে অভিযোগ জমা দিয়ে থাকেন, যা পর্যবেক্ষণ ও যাচাই-বাছাইকালেই ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়।

ফলে এ ধরনের অভিযোগ শুরুতেই বাতিলের খাতায় চলে যায়। তবে এর আগেই পরিকল্পিতভাবে কৌশলে দুদকে অভিযোগের বিষয়টি রং মিশিয়ে প্রচার করে দেওয়া হয়, যা নিরাপরাধ ওই ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের অভিযোগকারীকে শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন। আইনে এ বিধানটি যুক্ত করার দাবি জানান তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক বলেন, ‘সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসাবে দুদক দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিন নানা সোর্স থেকে দুদক কার্যালয়ে অভিযোগ জমা পড়ে। সেগুলো নিয়ম অনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষণ, যাচাই-বাছাই শেষে কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে জমা পড়া অনেক অভিযোগ তফশিলভুক্ত না থাকায় অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া যায় না।’

প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ প্রকাশিত ধারণা সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, টানা তিনবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত আপন-পর বিচার না করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। এটা করা সম্ভব হলেই দুর্নীতি কমবে, একই সঙ্গে এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ পাচারও বন্ধ হবে। তাতে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরবে দ্রুত।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার চেয়ে অভিযোগ জমা পড়ে বেশি। আবার অনেক অভিযোগ জমা পড়ে যেগুলো দুদকের এখতিয়ারভুক্ত নয় এটা সত্য।

কিন্তু কোন বিবেচনায়, কোন মাপকাঠিতে প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয়ে তিন ক্যাটাগরিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে দিলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। সবার কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে। অভিযোগকারীরা প্রতিকার না পেলে কিংবা কেন তার অভিযোগ আমলে নেওয়া হলো না, তা জানতে না পারলে দুদকের কাজের স্বচ্ছতা সম্পর্কে মানুষের ধারণা নষ্ট হবে।

আর যেসব অভিযোগ তদন্তের জন্য মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তরে পাঠানো হয়, সেগুলো সম্পর্কে দুদকের গুরুত্ব সহকারে ফলোআপ করা উচিত।

দেশে দুর্নীতি দমনে কাজ করা একমাত্র আইনি প্রতিষ্ঠান দুদক। দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই সংস্থার দ্বারস্থ হন। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানেও দেশের দুর্নীতির একটি ধারণাচিত্র পাওয়া যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দুদক থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে জানা যায়, গেল বছর সাতটি উৎস থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে জমা পড়েছে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ।

এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ১১ হাজার ৭৯৬টি অভিযোগ দুদকের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে জমা দেয় মানুষ। এছাড়া সরকারি দপ্তর ও সংস্থা থেকে ৯৬৭টি, বেসরকারি সংস্থা ও দপ্তর থেকে ৩৮৭টি, গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত প্রতিবেদন ১ হাজার ৩৫৪টি, দুদকের বিভাগীয় কার্যালয়ে ১ হাজার ৫৪৭টি, হটলাইন ও এনফোর্সমেন্ট বিভাগে ৫৮০টি এবং আদালত, ই-মেইল, ফেসবুকসহ অন্যান্য সোর্স থেকে আসে আরও ২ হাজার ৭০৭টি অভিযোগ। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মোট অভিযোগের ৬১ ভাগ জমা দিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

দুদকের পরিসংখ্যানমতে, ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ থেকে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়েছে মাত্র ৯০১টি। নথিভুক্ত করা হয়েছে ১৫ হাজার ২৮৫টি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগের নথি।

এ হিসাবে প্রাপ্ত মোট অভিযোগের শতকরা ৯৬ ভাগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেয়নি দুদক। উল্লেখ্য, কমিশনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তারা যেসব অভিযোগ অনুসন্ধান করে থাকেন, সেগুলোকে আমলে নেওয়া বলা হয়।

দুদকের অভিযোগ পর্যবেক্ষণ, যাচাই-বাছাই, অনুসন্ধান ও তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব মানুষ অভিযোগ জমা দেন, তারা সংস্থাটির তফশিলভুক্ত অপরাধের বিষয়ে সচেতন নন। অনেকে অভিযোগ লেখার ক্ষেত্রেও ভুল করেন। অনেক অভিযোগের কোনো ভিত্তি থাকে না। অনেকেই শত্রুতাসাধনে অভিযোগ জমা দিয়ে থাকেন। আবার অনেকেই তফশিলভুক্ত অপরাধের বিষয়ে জানালেও শুধু অভিযোগ লেখার ধরন ঠিক না হওয়ার কারণে তা আমলে নেওয়া যায় না।

কমিশন আইনে তফশিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে রয়েছে-সরকারি দায়িত্ব পালনকালে সরকারি কর্মচারী, ব্যাংকারসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোনো ব্যক্তির উৎকোচ (ঘুস), উপঢৌকন নেওয়া। সরকারি কর্মচারীদের নামে-বেনামে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করা। সরকারি অর্থসম্পদ আত্মসাৎ ও ক্ষতিসাধন, সরকারি কর্মচারীর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা। সরকারি কর্মচারী কর্তৃক জ্ঞাতসারে কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে রক্ষার প্রচেষ্টা, কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনকল্পে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক আইন অমান্য করা।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর অধীন সংঘটিত অপরাধগুলো এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃক জালজালিয়াতি ও প্রতারণা। এসব অপরাধের বিষয়ে কমিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ, ই-মেইল, হটলাইন-১০৬-এ টোল ফ্রি টেলিফোনের মাধ্যমে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন।

এছাড়াও লিখিতভাবে কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার বরাবর দুদক প্রধান কার্যালয়-১ ঢাকার ঠিকানা এবং আট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক বরাবর সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধীন সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ জমা দেওয়া যায়। অথবা কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক বরাবর সংশ্লিষ্ট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের অধীন সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ জমা নেওয়া হয়।

তবে কেউ কেউ বলেছেন, দুদকের অভিযোগ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক বিবেচনা বেশি প্রাধান্য পায়। দুর্নীতি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দুদককে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহারের অভিযোগ আছে। সংস্থাটি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তুলনামূলক কম ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে যতটা সরব, ততটাই নীরব প্রভাবশালীদের ব্যাপারে।

বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের অসৎ নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বিদেশে বাড়িগাড়ি করার অভিযোগ থাকলে দুদক এদের ব্যাপারে অনুসন্ধানে আগ্রহী নয়। এদের অনেকের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক সচিত্র প্রতিবেদনও প্রচার-প্রকাশিত হয়েছে। এরপরও তাদের দুর্নীতির অনুসন্ধানে আগ্রহী নয় দুদক।

অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক সংসদ-সদস্যের আমেরিকায় বাড়ি কেনার খবর নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ খবর এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এ ব্যাপারে অনুসন্ধানে দুদকের কোনো আগ্রহ এখনো দৃশ্যমান নয়। এছাড়া আমলাদের বিরুদ্ধেও অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়ে।

এসব অভিযোগের বেশির ভাগই পরিকল্পিতভাবে আমলে নেওয়া হয় না। যেগুলো আমলে নেওয়া হয়, সেগুলোরও বেশির ভাগ অনুসন্ধান পর্যায়েই নথিভুক্ত করা হয়। রেহাই পেয়ে যান দুর্নীতিবাজরা।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে ক্ষমতাধরদের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের আগ্রহ খুবই সীমিত। স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে দুদকের যে ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে কর্মরতদের নতজানু মানসিকতার কারণে সেই ভূমিকা রাখতে পারছে না। এখানে ক্ষমতাসীনদের প্রভাবের চেয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতনরা নিজেরাই নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বসে আছে।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম