নতুন বছর বিএনপির অগ্নিপরীক্ষা
আন্দোলনের সফলতার বিকল্প ভাবছে না দলটি * ধাপে ধাপে চূড়ান্ত পর্যায়ে নেওয়ার পরিকল্পনা
হাবিবুর রহমান খান
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শুরু হলো নির্বাচন ও আন্দোলনের বছর। এ দুই ইস্যুকে সামনে রেখে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে বিএনপি।
দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা জানান, ২০২৩ সাল তাদের জন্য কঠিন এক বছর। সরকার বিরোধী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে চলমান আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতার বিকল্প নেই। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে।
আন্দোলন দমাতে সরকার আরও কঠোর হবে এতে সন্দেহ নেই। রাজপথে সংঘাত-রক্তপাত হতে পারে এমনটা ধরে নিয়েই তারা এবার মাঠে নামবেন। কারণ, এবারের আন্দোলনে ব্যর্থ হলে নেতাকর্মীদের চরম মাশুল দিতে হতে পারে।
রাজনৈতিক ময়দানে টিকে থাকাই হবে কঠিন। তাই চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়ে নতুন বছরে আন্দোলনের ছক কষা হচ্ছে। রাজপথে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারেও দেওয়া হবে বিশেষ গুরুত্ব।
সূত্র জানায়, সরকার পতনের ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী কয়েক মাস শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেই থাকবে বিএনপি। ১১ জানুয়ারি সব বিভাগীয় শহরে ৪ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে এরপরও হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাবে না।
তফসিল ঘোষণার কয়েক মাস আগ থেকেই আন্দোলনের গতি বাড়ানো হবে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে সরকার একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেই চূড়ান্ত আন্দোলনে নামবে তারা। ১০ দফা তখন এক দফায় পরিণত হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ২০২৩ শুধু আমাদের নয় এ দেশের মানুষের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যাশা, দেশের মানুষ যে গণতন্ত্র হারিয়েছে তা এ বছর আদায় করবে। বাকস্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরে পাবে। ভঙ্গুর অর্থনীতিকে মেরামত করে একটা স্থিতিশীল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা হবে এ বছর।
তিনি বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে প্রত্যাশা পূরণ হবে না। সেজন্যই আমরা ১০ দফা দিয়েছি। যার প্রথম দফাই হচ্ছে সরকারের পতন। আশা করি, এ বছর জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে। যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক জনস্বার্থে আমরা যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি।
দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে বলেন, সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ রয়েছে। রাজপথে নামতে তারা একটি সুযোগের অপেক্ষা করছেন। আমাদের সেই সুযোগটিই তৈরি করতে হবে। এজন্য নতুন বছরে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আমরা এগোতে চাই। হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
তাদের মতে, গেল বছর সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করা হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় যোগ্য নেতৃত্বের কারণে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ এবং উজ্জীবিত। বিগত সময়ে বিভাগীয় শহরগুলো গণসমাবেশ এবং সবশেষ গণমিছিলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তৃণমূল থেকে দলকে এমনভাবে গুছিয়ে আনা হয়েছে যাতে যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা রাজপথে নামতে ভয় না পান।
বিএনপি সূত্র জানায়, সরকার পতন আন্দোলনকে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অলআউট মাঠে নামার আগে সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য আরও সুদৃঢ় করা হবে। নিজেদের মধ্যে যাতে দূরত্ব সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অনেক দলকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বাগিয়ে নেওয়া হতে পারে। তাই সরকারের কোনো প্রলোভনে যাতে কেউ না পড়ে সে ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে সমমনা অনেক ছোট দলের আবদারকে তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। তাদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন, মাঠের আন্দোলনে প্রধান শক্তি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। বাকি দলগুলোর সাংগঠনিক শক্তি ততটা নেই। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসাবেই তাদের পাশে রাখা হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ এমনকি বিদেশিদের কাছে একটা বার্তা যাবে যে সরকারবিরোধী প্রায় সব দলই একই প্লাটফরমে রয়েছে। তাই যে কোনো মূল্যে যুগপৎ আন্দোলনে সব দলকে একসঙ্গে মাঠে রাখবে বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, রাজপথে আন্দোলনে মামলাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে পারে সরকার। দলের সক্রিয় নেতাদের টার্গেট করে করা হতে পারে গ্রেফতার। ইতোমধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে সাংগঠনিকভাবে কিছুটা হলেও চাপে পড়েছে দলটি। এ চাপ সামনে আরও বাড়তে পারে। তাই নেতাদের গ্রেফতার করা হলেও নেতৃত্বশূন্যতায় যাতে আন্দোলনের গতি থমকে না যায় সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে হাইকমান্ড। তৈরি করা হচ্ছে কয়েক স্তরের নেতৃত্ব।
তাদের মতে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই নেতাকর্মীরা আজ ঐক্যবদ্ধ। আগামী দিনের আন্দোলন যাতে নেতা নির্ভর না হয় সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিগত কর্মসূচিতেও সেটা দেখা গেছে। সবশেষ ঢাকায় গণমিছিলকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক ছিল। এজন্য প্রকাশ্যে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। সক্রিয় নেতারা অনেকেই ছিলেন আত্মগোপনে। কর্মী-সমর্থকরা নেতাদের ওপর নির্ভর না করে স্বেচ্ছায় গণমিছিলে অংশ নেন। বিগত বিভাগীয় গণসমাবেশেও এ দৃশ্য দেখা গেছে। তাই আগামী দিনে সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার করা হলেও মাঠের আন্দোলনে সেটার প্রভাব তেমন একটা পড়বে না বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহাজাহান যুগান্তরকে বলেন, দেশ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। বর্তমান সরকার দানবের মতো সবার ওপর চেপে বসে আছে। সবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই এ সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে। সেটা সহজ হবে বলে মনে করি না। তবে জনগণের দাবি পূরণে এবার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অলআউট মাঠে নামব। মামলা-হামলা কিংবা গ্রেফতার করে তা বন্ধ করা যাবে না। ২০২৩ সাল হবে গণতন্ত্রের মুক্তির বছর।