পুলিশে সংস্কারের তাগিদ : প্রয়োজন অপারেশনালি অটোনমাস
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশ দেশের মানুষের বুকে নির্দয়ভাবে গুলি চালানোয় প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সর্বমহলে প্রশ্ন দেখা দেয়। বাহিনীটির এমন অবস্থার জন্য সদ্য পদত্যাগী সরকারই যে দায়ী ছিল, ক্রমেই তা স্পষ্ট হচ্ছে। বুধবার যুগান্তরের খবরে প্রকাশ-পদত্যাগী সরকারের আমলে পুলিশের পদোন্নতিতে হয়েছে নজিরবিহীন দুর্নীতি। ১৯৯৭ সালে ১৭১ কর্মকর্তা চাকরিতে যোগ দিলেও পদোন্নতির জন্য তারা যোগদানের তারিখ দেখিয়েছেন ছয় বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে। এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে তারা উপর মহলের সহায়তায় জ্যেষ্ঠ ৭৫০ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে (সুপারিসিড) পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি নেন। পরে তাদের অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পুলিশ সুপারও (এএসপি) হয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় এমন পদোন্নতির ফলে নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন ২ হাজার ২৫০ কর্মকর্তা।
জালিয়াতি তো বটেই, ১৭১ জনের পদোন্নতির প্রক্রিয়াটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমেই যে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। আশার কথা, ইতোমধ্যে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। বাহিনীর শীর্ষসহ সব পর্যায়েই বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। এ সম্পাদকীয় যখন লেখা হচ্ছে, তখনো পুলিশের তিন বড় কর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা থেকে জারি করা পৃথক প্রজ্ঞাপনে ১২ উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এবং ১১ পুলিশ সুপারকে (এসপি) রদবদল করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদবঞ্চিতরা পদোন্নতি ও শীর্ষপদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকবে, তা স্পষ্ট। কথা হচ্ছে, শুধু রদবদলই নয়, যারা দায়িত্বে আসছেন, তারা দায়িত্ব পালনে কতটা সৎ ও জনবান্ধব হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারবেন, সেটাই বিবেচ্য।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পুলিশবাহিনী যে ইমেজ সংকটে পড়েছে, তা থেকে উত্তরণে তাদেরই উদ্যোগী হতে হবে। বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের মাঝে আস্থা ফেরাতে শুধু পোশাক ও লোগো পরিবর্তন নয়, জনবান্ধবমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটাতে হবে। বিদ্যমান আইন সংশোধনেরও প্রয়োজন রয়েছে। আইনে পুলিশ প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন, পুরস্কার ও শাস্তির একটি অরাজনৈতিক ও নিরপেক্ষ পদ্ধতির বিধান রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রয়োজনে পুলিশকে সরকারের প্রভাবমুক্ত করতে স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে অপারেশনালি অটোনমাস (স্বায়ত্তশাসিত) পন্থায় কাজের সুযোগও দেওয়া যেতে পারে। আবার শুধু স্বাধীনতা দিলেই হবে না, ক্ষমতার অপব্যবহার যাতে না হয়, সেজন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টিও কঠোরভাবে প্রতিপালনের প্রয়োজন রয়েছে। সব মিলিয়ে ‘পুলিশ জনগণের নয়, সরকারের বাহিনী’ এমন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে অধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না, লোগো ও পোশাক পরিবর্তনের সঙ্গে পুলিশের পারফরম্যান্সের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই, সততার সঙ্গে আইনানুযায়ী কর্মকাণ্ডের মধ্যেই তা নিহিত। ফলে নির্বাহীদের অযথা নিয়ন্ত্রণ থেকে পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হলে অপারেশনালি স্বায়ত্তশাসন জরুরি। পুলিশের আওতাধীন কাজের ক্ষেত্রে কোনো মহলের অন্যায় অনুরোধ উপেক্ষা করলে শাস্তিমূলক বদলি বা পদায়নের শিকার যাতে না হতে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। জানমালের রক্ষাকর্তা পুলিশ বাহিনী কোনো মহলের হাতিয়ার হিসাবে নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই জনগণের হয়ে উঠবে, এটাই প্রত্যাশা।