ভয়ংকর প্রাণসংহারী মহামারি কোভিড ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের অনেক আপনজন, দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। এমনই ভয়ংকর মহামারিতে আমরা হারিয়েছি ৭৪ বছর বয়সি সফল শিল্পোদ্যোক্তা, যমুনা গ্রুপের ফাউন্ডার এবং চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে।
আমরা জানি বিদেশে অনেক মৃত ব্যক্তিদের ফিউরানেল, মেমোরিয়াল সার্ভিস বা শোক দিবসের ইউলোজি বা প্রশংসাপত্র পাঠের জন্য অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের ভাড়া করা হয়। প্রয়াত ব্যক্তির প্রশংসা স্তুতিতে থাকে ভাড়া করা শব্দমালা। যাতে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া ব্যক্তির গুণকির্তন করা হয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে। কিন্তু নুরুল ইসলাম এমন এক ব্যক্তিত্ব যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এরূপ শব্দের ভান্ডার ভাড়া করতে হয় না, কিংবা অতিরঞ্জিত করার প্রয়োজন হয় না। বরং তিনি যা তারই প্রকৃত বর্ণনা দিতে গেলে বক্তব্য দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।
একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে মাত্র ৭৪ বছর বয়সের মধ্যে তিনি যে নান্দনিক শিল্পকারখানা গড়ে তুলেছেন তা অনেকের পক্ষে বহু জীবনেও সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী ভিশনারি লিডার, উন্নয়নের আর্কিটেক্ট। তিনি বেভারেজ, টেক্সটাইল, কেমিক্যালস, কনস্ট্রাকশন, লেদার, ইঞ্জিনিয়ারিং, মিডিয়া, ইলেকট্রিক এক্সেসরিস কারখানা, সু ফ্যাক্টরিসহ ৪১টি সেক্টরে অবদান রেখেছেন। তার পদচারণা ছিল না এমন সেক্টর খুব কমই। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই সফল হয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন উন্নতির পরবর্তী ধাপে। তার হাতে গড়ে ওঠা যমুনা ফিউচার পার্ক, যুগান্তর পত্রিকা, যমুনা টেলিভিশন, হবিগঞ্জের টেক্সটাইল মিল, অত্যাধুনিক শপিংমলগুলো নিজ নিজ সেক্টরের পথিকৃত।
আমি অগ্রণী ব্যাংকের এমডি এবং সিইও হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণের পরই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। ব্যাংকিং সেক্টরে তার যথেষ্ট সুনাম থাকায় তাকে আমরা আমাদের ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের আওতায় আনার জন্য সোনারগাঁও হোটেলের কেক নিয়ে আমার এপিএসসহ একদিন তার অফিসে গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। আমি সরকারি ব্যাংকের একজন এমডি হওয়ায় তিনি প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ ব্যাংকের সমালোচনা করলেন। সে সময় ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে তার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করলেন। আমি তার অভিজ্ঞতাগুলো শুনলাম এবং কিছু কিছু অভিযোগ খণ্ডানোর চেষ্টা করলাম আমার মতো করে। আমার সঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে তিনি তার একজন ডিজিএমকে ডেকে আনলেন এবং আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন অগ্রণী ব্যাংকের নতুন এমডি সাহেব এসেছেন, তাকে আমার অনেক ভালো মানুষ-ই মনে হচ্ছে। এবং উনি সেই ডিজিএম সাহেবকে অ্যাকাউন্ট করার নির্দেশ দিলেন। আর আমরা ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করলাম। তখন থেকেই মূলত যমুনা গ্রুপের সঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের পথচলা শুরু হলো। তার সঙ্গে আলাপ করে বের হয়ে আসার সময় তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাদের সঙ্গে অনেকদূর পর্যন্ত লিফটের কাছে চলে এলেন এবং লিফটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না লিফটের দরজা বন্ধ হলো। যেটা তিনি না করলেও পারতেন, এতটা সৌজন্যবোধ না দেখালেও পারতেন। তার সেই দিনের সেই অ্যাটিকেট তাকে আমার কাছে অন্য ধরনের একজন মানুষ হিসাবে তুলে ধরে। তার সেই ছবি আমার চোখে এখনো জীবন্ত।
এরপর আমাদের ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের নির্বাহীদের নিয়ে তার হবিগঞ্জের কারখানা পরিদর্শনে গেলে তিনি সেখানেও আমাদের অনেক সময় দেন এবং জার্মান টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। কয়েক ঘণ্টা সময় ধরে আমাদের সেই শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যবস্থা ঘুরিয়ে দেখান। তিনি সব সময় ব্যাংকের পাওনা সময়মতো পরিশোধ করেছেন। হাজারও স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নকারী এ মানুষটি কোভিড মহামারির কাছে হেরে যান। তার মৃত্যুর পরও এ পরিবারটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক অব্যাহত আছে। প্রয়াণ দিবসে নুরুল ইসলামকে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
লেখক:
সাবেক এমডি এবং সিইও অগ্রণী ব্যাংক