সফল স্বপ্নসারথি
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
খ্যাতিমান শিল্পোদ্যোক্তা যমুনা গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে (১৯৪৬-২০২০) আমরা দেশের শিল্প-ভাবনার একজন বিশিষ্ট রূপকার এবং সমাজসেবক হিসাবেই জানতাম। আমি যখন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ছিলাম, তখন তাকে একজন সফল ও ন্যায়নিষ্ঠ করদাতা হিসাবে পেয়েছিলাম। শিল্প স্থাপন, পণ্য উৎপাদন, বিপণন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি সরকারকে মোটা অঙ্কের রাজস্বের জোগান দিতেন। কঠোর পরিশ্রম, মেধা আর দূরদর্শী চিন্তার সমন্বয়ে তিনি একজন শিল্প উদ্যোক্তা হিসাবে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি যে কোনো চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী ছিলেন। কঠোর পরিশ্রম, দূরদর্শী চিন্তাভাবনা ও অত্যন্ত মেধাবী হওয়ার কারণে তিনি দ্রুত এগিয়ে যেতে সক্ষম হন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্বাসন প্রয়াস চলছিল, তখন এ দেশকে একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছিল। তখন এ ধারণাও পরিব্যাপ্ত হয়েছিল যে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিকভাবে টিকে থাকা কঠিন হবে। কিন্তু সেই সমালোচনাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে মুক্তিযুদ্ধের কর্মতৎপর উদ্যম-উদ্দীপনা নিয়ে যারা উদ্যোগী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন নুরুল ইসলাম। সেসময়ে দেশে কোনো কার্যকর অবকাঠামো ছিল না। অনেক ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা কাজ করেছেন। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন; দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বয়ম্ভর হওয়ার পথে বর্তমানে যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে তা কিন্তু কোনো সীমিত সময়ে কোনো একক পক্ষের দ্বারা সম্ভব হয়নি, এটি নুরুল ইসলামের মতো শিল্পোদ্যোক্তাসহ বাংলাদেশের আমজনতার সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল।
জাপানের টোকিওস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসে আমি ছয় বছর কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছি। সেসময় দেখেছি জাপানের অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে হাইটেক প্রযুক্তি। তারা একসঙ্গে সব কিছুকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বেশি মূল্যসংযোজন হয়েছে। দেশ শিল্পোন্নত হয়েছে। নুরুল ইসলাম যখন যমুনা ফিউচার পার্ক করেন, তখন আমার মনে হয়েছে তিনি জাপানের সেই ধারণাকে কাজে লাগিয়েছেন। এক ছাতার নিচে সবকিছুকে নিয়ে এসেছেন। এতে খরচ ও দাম কমছে। ফলে ভোক্তার সুবিধা হয়েছে। উদ্যোক্তার জন্য বাজার ধরাও সহজ হয়েছে।
সমকালীন বাংলাদেশের সব পত্রিকায়ই রাজনীতিনির্ভর সংবাদকে প্রধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি যখন যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশ করেন তখন তাতে রাজনৈতিক সংবাদের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংবাদকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। এর সম্পাদকীয় পাতার বিশ্লেষণকে অবাধ ও নিরপক্ষে মনে হয়েছে। যে কারণে আমিও এ পত্রিকার সঙ্গে কমবেশি লেখালেখিতে যুক্ত আছি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। তার হাতেই সৃজিত হয়েছে বিশ্বের অনন্য এক খোলা জানালা হিসাবে যমুনা টিভি। এতেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি সব সময়ই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতেন। বিনিয়োগ কর্মসংস্থানেই ছিল তার নজর। এ কারণে তাকে অনেকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে। তিনি সেগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। তার সেই মেধা ও পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ। তার মতো একজন সৃজনশীল মানুষের মাত্র ৭৪ বছর বয়সে প্রয়াণে গোটা বাংলাদেশ ব্যথিত হয়েছে। করোনাকালে তার এ মৃত্যু ছিল আমাদের জন্য বড় দুঃসংবাদ।
২০২০ সালে যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। তখন নুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাকে সম্মান ও সৌজন্য প্রদর্শনে এ বিশাল ব্যক্তিত্বের সদাহাস্য আন্তরিকতায় বিমুগ্ধ ছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়ি তার এলাকায় হওয়ায় বিক্রমপুরের জামাই হিসাবেও পেয়েছি পরম আতিথেয়তা। ২০২০ সালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। ছবি তুলেছিলাম। ওনার সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে দেশের শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে যমুনা গ্রুপকে ঈর্ষণীয় সাফল্যের জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন তিনি।
২.
করোনাকাল কাটিয়ে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের বিরূপ প্রভাবে বিধ্বস্ত সময়ে আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম ও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সময় আজ একজন নুরুল ইসলামের অভাব ভীষণভাবে অনুভব করছি। তার মুখ বারবার ভেসে উঠছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর অপরূপ রূপ অনুভবের আয়নায় উপলব্ধির কালে। বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের বিষয়ে তার স্বচ্ছ ধারণা ছিল। ফলে তিনি সব সময় দেশে আমদানির বিকল্প শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতেন। সেগুলো বাস্তবায়নের ফলে একদিকে দেশের আমদানি ব্যয় কমেছে, অন্যদিকে দেশে ওইসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। দেশ স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে। সব মিলে দেশের উন্নতি হয়েছে।
সিলেটে যে শিল্পনগর তিনি গড়ে তুলেছেন, তা স্রেফ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বৃহত্তর বিশেষ অর্থনৈতিক শিল্প জোন। সরকার মীরসরাইয়ের চরে বঙ্গবন্ধু শিল্লনগর গড়ে তুলতে যে কর্মযজ্ঞ চালিয়েছে, দেশি-বিদেশি পুঁজি, প্রকৌশল, প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে-চিন্তা করা যায় একজন ব্যক্তি নুরুল ইসলামের নিজস্ব ভাবনা, কর্মকুশলতায় যমুনা শিল্পনগর গড়ে উঠেছে! এখানেই মরহুম নুরুল ইসলামের ব্যক্তিসত্তার বহুল প্রজ প্রত্যয়, ব্যতিক্রমী শিল্পোদ্যোক্তা পরিচয় নিহিত। ৪৬ বছরে তিনি যে শিল্প সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন, তাতে তার মননের পরিচয় পাওয়া যায়। সেরা কোয়ালিটির পণ্য উৎপাদন করছে যমুনা গ্রুপ। ১৯৭৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা একটার পর একটা শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
৩.
তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণসভায় যুগান্তরের স্বনামধন্য সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলমের স্বতঃপ্রণোদিত মূল্যায়ন আমার এখনো মনে পড়ে। সাইফুল আলম সেদিন বলেছিলেন, ‘নুরুল ইসলামের মতো এমন কর্মবীর মানুষ হয় না। এত বড় স্বপ্ন কখনো মানুষ দেখে না। তিনি স্বপ্নের চেয়েও বড় ছিলেন। তার মতো এমন সাহসী পুরুষ আর হয় না। জীবনযুদ্ধে জয়ী এমন নাবিকের সন্ধান বাংলাদেশে আর পাওয়া যাবে না। মাত্র তিন যুগে ৪১টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এককভাবে, নিজের চেষ্টায়।’
সাইফুল আলম স্মরণ করেন, ‘যমুনা গ্রুপ সেই প্রতিষ্ঠান, যার একটি টাকাও বিদেশে নেই। যমুনা গ্রুপ সেই প্রতিষ্ঠান, যার চেয়ারম্যানের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও বিদেশে নেই। সারা জীবন তিনি টাকা পাচারের বিরুদ্ধে বলেছেন, সম্পদ পাচারের কথা বলেছেন। তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য, দেশের মাটির জন্য, দেশের মানুষের জন্য।’
প্রখ্যাত কলামিস্ট, সাংবাদিক এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির’ রচয়িতা প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতে, নুরুল ইসলাম যে এত বড় শিল্প-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তা দেখলে মনে হয় না। আমাকে দেখে সাদরে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এত বড় শিল্পপতি, এতটুকু অহংকার নেই। যুগান্তর পত্রিকাকে কী করে সব মানুষের প্রিয় পত্রিকা হিসাবে গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করলেন।
বাজারে তখন একটি বিশেষ পত্রিকার একাধিপত্য চলছিল, যুগান্তর তাদের মনোপলি প্রথম ভেঙেছে সে কথা তাকে জানালাম; আরও জানিয়েছিলাম, যুগান্তর শুধু একটি দৈনিকের মনোপলি ভাঙেনি, ইতোমধ্যেই নিজের এক বিশাল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছে, যা সহজে কেউ ভাঙতে পারবে না। আমার সঙ্গে যমুনা টেলিভিশনে কথোপকথনে তিনি শিল্প সাম্রাজ্য স্থাপনের ইতিহাস বলেছিলেন। এমন সাদাসিধে সরস বর্ণনা আমি একজন ব্যবসায়ীর মুখে আশা করিনি। গাফ্ফার চৌধুরী যমুনা টেলিভিশন কেন্দ্র দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। তার পর্যবেক্ষণ-‘মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের একটি অসাধারণ গুণ ছিল তার বিচক্ষণতা ও মানুষ চেনার এক অদ্ভুত ক্ষমতা। কার অন্তর্নিহিত শক্তি কী, তা তিনি খুব সহজেই বুঝতে পারতেন। আর তাই সুযোগ্য ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিক সাইফুল আলমের ওপর নির্ভর করতেন অনেকটাই। সাইফুল আলম প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই যুগান্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।’
দেশে করোনা মহামারি দেখা দিলে তিনি তার বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে নেমেছিলেন। করোনা চিকিৎসায় কুড়িলে আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। করোনা মোকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিয়েছিলেন ১০ কোটি টাকা। তাছাড়া করোনা মোকাবিলার জন্য তৈরি করেছিলেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এ স্যানিটাইজার দামেও খুব সস্তা।
আমরা মরহুম নুরুল ইসলামের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং যমুনা শিল্প পরিবারের নিরাপদ সাফল্য ও অগ্রযাত্রা প্রত্যাশা করি।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান