অংশীদারের সঙ্গে প্রতারণা
শতকোটি টাকার শপিং মল ফারুকের দখলে
বকেয়া ঋণে নিলামের পথে ভবন * বিপাকে দোকান ও ফ্ল্যাট মালিকরা
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে প্রতারণা করে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় গড়ে তোলেন অত্যাধুনিক শপিংমল। প্রায় ৩০ কাঠা জমির ওপর নির্মিত থিম ওমর প্লাজা নামের ১০ তলা ওই ভবনে ৯ ও ১০ তলায় রয়েছে আবাসিক ফ্ল্যাট। প্রথম তলা থেকে আটতলায় দোকানের সংখ্যা ২৮০টি। ভবনের ৩৫ শতাংশের মালিকানা রেখে বাকি ৬৫ শতাংশ চুক্তিতে বিক্রি করেন ফারুক চৌধুরী। অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকঋণ ও যৌথ অর্থায়নে নির্মিত ওমর প্লাজার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে অংশীদারকে তাড়িয়ে দিয়ে গোটা ভবন দখলে নেন তিনি। ফ্ল্যাট ও দোকান বিক্রি করে হাতিয়ে নেন কয়েকশ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকের ঋণ শোধ না করায় ওমর প্লাজা এখন নিলামে উঠতে যাচ্ছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন ফ্ল্যাট মালিক ও দোকান মালিকরা। এরই মধ্যে প্রিমিয়ার ব্যাংক ঋণের টাকা আদায়ে ভবনের নিলাম প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
ভুক্তভোগীরা দোকান ও ফ্ল্যাট চড়া দামে কিনেছেন। একেকটি দোকানের সেলামি নিম্নে ৩০ থেকে ঊর্ধ্বে ৬০ লাখ টাকা। আর একেকটি আবাসিক ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন নিম্নে ৬০ থেকে ঊর্ধ্বে ৮০ লাখ টাকায়। আবাসিক ফ্ল্যাটের সংখ্যা ৩৩টি। তাদের কাউকে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়েছে, আবার অনেককেই দেওয়া হয়নি। ফারুক চৌধুরী কৌশলে প্লাজার সব আবাসিক ফ্ল্যাট ও দোকান বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন-এটা তারা জানতেন না। ব্যাংকের লোকজন এখন প্লাজার সব সম্পদ পরিমাপ করছেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে ফারুক চৌধুরী সপরিবারে আত্মগোপনে। ইতোমধ্যে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ফারুক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
জানা যায়, থিম রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করে ২০১২ সালে ফারুক ভবনটির নির্মাণ শুরু করেন। এরপর তিনি অর্থের প্রয়োজন দেখিয়ে ভবনের অংশীদার খুঁজতে থাকেন। ইঞ্জিনিয়ার কেএম মোস্তাফিজুর রহমান নামের একজন ব্যবসায়ীকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে তার কাছে ভবনের ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেন। বাকি ৪০ শতাংশ শেয়ার দুই অংশীদারের কাছেই থাকে। চুক্তি অনুযায়ী শেয়ারের আনুপাতিক হারে নির্মাণ ব্যয় বহন করেন অংশীদাররা। দোকান ও ফ্ল্যাট বুকিং বাবদ অর্থ সমানুপাতিকভাবে নির্মাণ খাতে ব্যয় নির্বাহ হয়। নির্মাণ সম্পন্ন হলে দোকান ও ফ্ল্যাট বিক্রয় বাবদ অর্থ শেয়ার অনুযায়ী বণ্টন হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৮ সালে ফারুক নিজেকে পুরো ভবনের একক মালিকানা ঘোষণা করেন।
প্রতারিত হয়ে মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৯ সালে ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মামলার কার্যক্রম আটকে দেন ফারুক চৌধুরী। সম্প্রতি মামলাটি সচল হয়েছে। আদালত থেকে ফারুক চৌধুরীকে সমন জারি করা হয়েছে।
আরও জানা যায়, ভবন বা প্লাজা নির্মাণ শুরুর আগেই ফারুক চৌধুরী জমির বিপরীতে একটি ব্যাংক থেকে ৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। তা গোপন রেখেই ২০১২ সালে মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে ভবন নির্মাণ ও মালিকানাসংক্রান্ত চুক্তি করেন। ফারুক চৌধুরী আগের ৯ কোটি টাকা ঋণের তথ্য গোপন করে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা থেকে আরও ২৬ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। প্লাজার অংশীদার হিসাবে মোস্তাফিজুর রহমান এককভাবে ঋণের ১৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। তবে অংশীদার মোস্তাফিজুর রহমান বিতাড়িত হয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দেন। ভবনের পুরো মালিকানা দখলে নিলেও ফারুক চৌধুরী নিজেও আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেননি। বর্তমানে থিম ওমর প্লাজার বিপরীতে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ কোটি ৫১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংক থিম ওমর প্লাজা নিলামের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। প্রিমিয়ার ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি না হলেও ঋণ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশ্যে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হবে।
ভবন জবরদখলের বিষয়ে থিম রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ২০১৮ সালের মে মাসে ঈদের আগে তিনি ঢাকায় যাওয়ার পরদিন খবর পান-ফারুক চৌধুরী দলীয় সন্ত্রাসীদের নিয়ে গোটা ভবন থেকে তার পক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে বের করে দিয়েছেন এবং নিজেকে একক মালিক ঘোষণা করেছেন।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৮ সালেই থিম প্লাজার আনুমানিক বাজারমূল্য ছিল ১০০ কোটি টাকা। এখন প্লাজার মূল্য ৩০০ কোটির বেশি। ফারুক চৌধুরীর ৩৫ শতাংশ মালিকানার বিপরীতে বিনিয়োগ ছিল ৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু ভবনটি এককভাবে দখল করে আমার প্রাপ্য ৬৫ কোটি টাকার মালিকানাও কেড়ে নিয়েছেন। কোনো অ্যাপার্টমেন্ট বা দোকান বিক্রির অর্থও পাইনি। ভবনের মালিকানা ফিরে পেতে পুনরায় আইনি লড়াই শুরু করেছি।
থিম ওমর প্লাজার ঋণ পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বলতে প্রিমিয়ার ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি। তবে ব্যাংকটির সাবেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসিবুল আসাদ বলেন, যতদূর জানি থিম ওমর প্লাজা নিলাম প্রক্রিয়া চলছে। ব্যাংক বকেয়া ঋণের টাকা না পেলে নিলাম করবে এটাই স্বাভাবিক। ওই প্লাজার দোকান মালিক সেলিম হোসেন বলেন, আমরা যারা বিপুল অর্থ দিয়ে দোকান নিয়েছি তাদের কী হবে-যদি ভবন নিলাম হয়ে যায়। ফারুক চৌধুরী পালিয়ে আছেন। আমরা জেনেছি আগে ফারুক চৌধুরী ছিলেন প্লাজার চেয়ারম্যান। তবে ৫ আগস্টের পর গোপনে স্ত্রী নিগার সুলতানা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করেন। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ চারজন থেকে বাড়িয়ে করেন নয়জন, যা অন্য অংশীদারদের অজানা ছিল। কাগজপত্র অনুযায়ী স্ত্রী নিগার সুলতানা চৌধুরী কোম্পানির চেয়ারম্যান। বড় মেয়ে নাফিজা হক চৌধুরী ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অন্য দুই মেয়ে নাবিলা সুলতানা চৌধুরী ও রাফিয়া সারারা হক চৌধুরী এবং ছেলে মাশরুরুল হক চৌধুরী কোম্পানির পরিচালক।
কেএম মোস্তাাফিজুর রহমান বলেন, ‘একটি লিমিটেড কোম্পানিতে শেয়ার পরিবর্তন বা নীতিমালা সংশোধনের জন্য সব অংশীদারকে জানাতে হয় এবং অনুমোদন লাগে। কিন্তু ফারুক চৌধুরী এককভাবে সবকিছু করেছেন। তিনি ৫ আগস্ট থেকে পলাতক। সরকারি অফিসে গিয়ে তাহলে কাগজপত্রে এত পরিবর্তন করল কে? বিষয়টি তদন্ত হওয়া উচিত।
জানা যায়, কৌশলে ফারুক চৌধুরী থিম ওমর প্লাজার মালিকানা দখলে রেখেছেন। বড় মেয়ের শ্বশুর জামালপুরের সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতা রশিদুজ্জামান মিল্লাত। তার ছেলে শাহাদাত বিন জামান শোভন বর্তমানে শ্বশুর ফারুক চৌধুরীর ব্যবসা ও সম্পত্তির দেখভাল করছেন। ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমানের দাবি, ঢাকার গুলশানে বেয়াইয়ের বাড়িতেই পরিবারসহ লুকিয়ে আছেন ফারুক চৌধুরী। যদিও এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ওমর ফারুক ও পরিবারের অন্যদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। জামাতা শোভনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন, এরপর আর ফোন ধরেননি।
