ঢাকায় পারভেজ হত্যা
তুচ্ছ ঘটনায় খুন, মামলায় আসামি আট শিক্ষার্থী
বৈষম্যবিরোধী ৫ জনকে দায়ী করল ছাত্রদল * অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি উমামা ফাতেমার * ভালুকায় বিক্ষোভ-অবরোধ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজের (ইনসেটে) লাশ ময়মনসিংহের ভালুকার বাড়িতে পৌঁছার পর তার মা ও স্বজনের আহাজারি -যুগান্তর
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজধানীর বনানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাইম এশিয়ার টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যায় আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এতে অজ্ঞাতনামা ২০-৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দুই নারীকে নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসাহাসির জেরে রোববার সন্ধ্যায় কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাত ৮টায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। এদিকে পারভেজকে নিজেদের কর্মী দাবি করে এ হত্যাকাণ্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫ নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে ছাত্রদল। রোববার সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব দাবি করেন, হত্যাকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত। এদিকে রোববার রাতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া পারভেজ হত্যার বিচার দাবিতে ময়মনসিংহের ভালুকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন উপজেলা ছাত্রদল ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেফতারের আলটিমেটাম দিয়ে অবরোধ তুলে নেন ছাত্ররা।
বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার যুগান্তরকে বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে পারভেজ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। পারভেজের মামাতো ভাই হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে রোববার বনানী থানায় হত্যা মামলা করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মাহাথীর হাসান, মেহেরাজ ইসলাম ও এলএলবির ছাত্র আবু জহর গিফারী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী থানার যুগ্ম আহ্বায়ক শুভহান নিয়াজ তুষার ও যুগ্ম সদস্য সচিব হৃদয় মিয়াজীসহ ৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পারভেজের ময়নাতদন্ত করেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক প্রভাষক ডা. ফারহানা ইয়াসমিন। এ সময় পারভেজের স্বজনদের আহাজারিতে মর্গের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। বনানী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মওদুদ কামাল সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, শনিবার বিকালে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর জখম হন পারভেজ। পরে তাকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার বুকের বাম পাশে একটি জখমের চিহ্ন রয়েছে।
মর্গে পারভেজের মামাতো ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, আমার ভাই শান্ত স্বভাবের ছিল। কোনো মারামারির মধ্যে ছিল না। শিঙাড়া খাওয়া ও হাসাহাসির ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যা করা হয়েছে, শুধু এই ইস্যুই নয়, এর নেপথ্যে অন্য কারণ থাকতে পারে। এক ভাই, এক বোনের মধ্যে পারভেজ বড়। ছোট বোন মাইলস্টোন কলেজে পড়াশোনা করে। তার বাবা জসিম উদ্দিন ৯ বছর ধরে কুয়েতে থাকেন। মা পারভীন আক্তার গৃহিণী। বাড়ি ভালুকা উপজেলার ফাই চান গ্রামে। পারভেজ কাফরুলে আলহেরা হাসপাতালের পাশে মেসে থাকত।
পারভেজের প্রথম জানাজা দুপুরে পল্টনে বিএনপি দলীয় কার্যালয়ের সামনে হয়। প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তার মৃতদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, শনিবার বিকালে ক্যাম্পাসের পাশে একটি দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে শিঙাড়া খাচ্ছিলেন পারভেজ। তার সঙ্গে সদ্য ভর্তি হওয়া তিনজন ছাত্রী ছিলেন। একপর্যায়ে দুই ছাত্রী অভিযোগ করেন পারভেজ তাদের উত্ত্যক্ত করেছেন। তারা বিষয়টি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির প্রক্টরকে জানান। এরপর প্রক্টর পারভেজকে ডেকে নেন। প্রক্টর অফিসে পারভেজ দাবি করেন, তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নিজেদের আলাপের বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন, কাউকে উত্ত্যক্ত করেননি। একপর্যায়ে ওই দুই ছাত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হলে পারভেজ ক্ষমাও চান। সেখানেই ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা পারভেজকে হুমকি দেন। প্রক্টরের অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পর বহিরাগতদের নিয়ে এসে পারভেজের ওপর হামলা করা হয়। একপর্যায়ে ধারালো কিছু দিয়ে পারভেজের বুকে আঘাত করে তারা পালিয়ে যায়। পরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের বাইরে কয়েকজন দেশীয় অস্ত্র দিয়ে একের পর এক আঘাত করে পারভেজকে। একপর্যায়ে দৌড়ে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন পারভেজ।
রোববার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল সভাপতি রাকিব পারভেজ হত্যার জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বনানী এলাকার ৫ নেতাকে দায়ী করেন। এদিকে ছাত্রদলের এই অভিযোগ ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে মিথ্যা ও বানোয়াট দাবি করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যায় ছাত্রদল পারভেজের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরে একটি সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। এদিকে রোববার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। পরে হত্যাকারী ও তাদের সহযোগীদের গ্রেফতারসহ তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেন, ইংরেজি, আইন এবং বিবিএ ডিপার্টমেন্টের তিনজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। যা মিটমাট করে দেওয়া হয়। এরপরও এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি। প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. রায়হানা বেগম বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে যা যা করণীয় সব সহযোগিতা করা হবে। আমরা এর সঠিক বিচার প্রত্যাশা করি।
গ্রামের বাড়িতে মাতম: ভালুকা প্রতিনিধি জানান, পারভেজের গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সে পারভেজের মৃতদেহটি পৌঁছায় গ্রামের বাড়িতে। সেখানের পরিবেশ আরও ভারী হয়ে উঠে। পারভেজের বাবা-মা ও বোনের আহাজারিতে এলাকার মানুষজনও কান্নায় ভেঙে পড়েন। পারভেজের মা পারভীন আক্তার বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। পারভেজের বাবা জসিম উদ্দিন জানান, তিনি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে কুয়েতে থাকেন। সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্যই তিনি প্রবাস জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমার সন্তানকে কেউ হত্যা করতে পারে আমি বিশ্বাস করতে পারি না।
অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে : জাহিদুল ইসলাম পারভেজের হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছেন, পারভেজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী হামলায় নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন। রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে তার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। রোববার রাতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে উমামা ফাতেমা বলেন, আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি- এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘিরে ছাত্রদল একটি ঘৃণ্য রাজনৈতিক অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। হত্যার প্রকৃত কারণ, প্রকৃত অপরাধী ও ক্যাম্পাসে সহিংসতা ছড়ানোর পেছনে থাকা বাস্তবচিত্রকে আড়াল করে তারা ঘটনার রাজনৈতিক ব্যবচ্ছেদে মনোযোগী হয়েছে। এমনকি গণ-অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে এই হত্যার মদদদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করে যাচ্ছে। আমরা এই রাজনৈতিক অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ক্যাম্পাসগুলোর নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ ধরে আমরা একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই-গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়? কেন এমন ঘটনা বারবার ঘটছে এবং কারা শিক্ষাঙ্গনকে সহিংসতার আস্তানায় পরিণত করছে? এসব প্রশ্নের উত্তর ইন্টেরিম সরকারকে দিতে হবে। আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার সংগ্রামে আগে যেমন ছিলাম, আগামীতেও থাকব।
