
প্রিন্ট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৬ এএম
বর্ষার আগেই উদ্বেগে নগরবাসী
সিলেটে এবারও ভয়াবহ জলাবদ্ধতার আশঙ্কা
জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

সংগ্রাম সিংহ, সিলেট
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
জলাবদ্ধতা-বন্যা সিলেট নগরবাসীর জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষা শুরু হলেই উদ্বেগে থাকেন নগরবাসী। গত বছরের জুনে মাত্র ১৫ দিনে পরপর তিন দফা বন্যার পানিতে টইটম্বুর হয়েছিল প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট নগরী। হরদম নৌকা চলেছে নগরীর রাস্তার ওপর দিয়ে। এবার উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বর্ষা শুরুর আগেই। এখন ২৭টি ওয়ার্ড থেকে সিলেট সিটি করপোরেশনের পরিধি বেড়ে হয়েছে ৪২ ওয়ার্ডের। এর মধ্যে নগর ভবনে নেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব পালন করলেও তারা নগরীর ওয়ার্ডগুলোর অবস্থা সম্পর্কে ততটা ওয়াকিবহাল নন। তাছাড়া নগর ভবনে নেই কোনো স্থায়ী পরিকল্পনাবিদও। নগরীর মাস্টারপ্ল্যানও শুধু কাগজেই। কেউ জানে না কী আছে সেই মাস্টারপ্ল্যানে। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা মোকাবিলার প্রকল্পটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে ১০ হাজার কোটি টাকার তিনটি প্রকল্প হলেও তিনটিই এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এর মধ্যে দুটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায়, আরেকটি শিগগিরই জমা হবে। এতেই শেষ নয়; নগরভবনের দায়িত্বশীল নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সিসিক চরম অর্থাভাবেও আছে। চাইলেই অনেক কিছু করা যাচ্ছে না, যাবে না। সিসিক উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার বলেও অভিযোগ তুলছেন খোদ নগরভবনের দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ।
এর আগে জলাবদ্ধতা নিরসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে ১২২৫ কোটি টাকার একটি এবং ৫০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্পের কাজ হলেও তেমন কোনো সুফল আসেনি। নগরীকে জলাবদ্ধতা ও বন্যামুক্ত করা যায়নি। তাই ফের আরও বড় প্রকল্পের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে সিসিক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে একটি করে প্রকল্প জমা দিলেও এখন তা অনুমোদন করেনি মন্ত্রণালয়। সিসিকের আরও একটি প্রকল্প আগামী সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা।
এমন পরিস্থিতিতে বর্ষা সামনে রেখে চরম উদ্বিগ্ন নগরবাবাসী। ক্ষুব্ধ সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি যুগান্তরকে বললেন, সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত নগরী। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ঢল থাকে সারা বছর। আমার সময়ে বর্ষা মৌসুম শুরুর ৫-৬ মাস আগেই সিলেট সিটি করপোরেশনের ড্রেন, ছড়া, নালা, খাল পরিষ্কার করিয়ে নিতাম। তারপরও জলাবদ্ধতা থেকে নগরীকে রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়াত। কারণ সিলেট নগরীর ভূমি-প্রকৃতি অন্যান্য সিটির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। আর তখন সিটি ছিল মাত্র ২৭ ওয়ার্ডের। এখন নগরীর বিস্তৃতি বেড়েছে, হয়েছে ৪২ ওয়ার্ডের। অথচ অতীতের কাজটুকুও এখনো হয়নি। বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে। চৈত্রের এক পসলা বৃষ্টিতেই অনুমান করা গেছে নগরীর কী অবস্থা হতে পারে আগামী বর্ষায়। অথচ নগরভবন যে পরিচর্যার কাজ করে যাচ্ছে তাতে জলাবদ্ধতা নিরসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দ্রুত যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়া হলে এবার গোটা নগরী জলাবদ্ধতায় টইটম্বুর হবে। বৃষ্টি নামলেই পুরো নগরী ডুববে এটা অনেকটা নিশ্চিত। এ নিয়ে পরামর্শ করতে, নাগরিক উদ্যোগ নিতে নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে শিগগির ব্যক্তিগত উদ্যোগে মতবিনিময় সভা ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাবেক মেয়র আরিফ।
এদিকে নগরীকে জলাবদ্ধতা ও বন্যা থেকে মুক্ত রাখতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের প্রেক্ষিতে সুরমা নদীর খনন কাজ শুরু করা হয়েছিল ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে। ২০২৩ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয়েছে গত বছর। তাও নানা অজুহাত দেখিয়ে যেনতেনভাবে ইতি টানা হয় কাজটির। ফলে বর্ষার পদধ্বনি শোনার পর থেকে আতঙ্কে উদ্বেগে নগরবাসী।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের জেলা সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকলেও নগর প্রশাসন দায়িত্বে রয়েছে। তারা নাগরিকের কোনো দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে তারা মেয়রদের নেতৃত্বে অনেকদিন ধরে কাজ করেছেন, অভিজ্ঞতাও আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তাদের দ্রুত কাজ শুরু করা উচিত। এ নিয়ে অজুহাত, টালবাহানা করতে থাকলে জলাবদ্ধতা-বন্যাকবলিত নগরবাসীর ক্ষোভ শুধু তাদের ওপরই নয়, সরকারের ওপরও পড়বে। তিনি বলেন, আমিসহ নগরীর কয়েকজনকে নিয়ে নিকট-অতীতে নগরভবন একটি কমিটি করেছিল পুকুর গণনা ও যথাযথ সংরক্ষণের লক্ষ্যে। সেই কমিটির বয়স কয়েক বছর হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত কোনো সভা ডাকা হয়নি। এই হলো নগরভবনের প্রকল্পগুলোর পরিণতি।
সিসিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রধান প্রকৌশলীর পদে আছেন প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। তিন মেয়রের মেয়াদেই তিনি ছিলেন প্রকৌশলীর চেয়ারে। নগরীর জলাবদ্ধতা, বন্যা, বরাদ্দ সবকিছুই তার নখদর্পণে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সিসিকে ১২২৮ কোটি টাকার প্রকল্প ছিল জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য। আমরা সেই অর্থে সাড়ে ৪শ কিলোমিটার ড্রেন করেছি। গত সরকারের সর্বশেষ দায়িত্বে থাকা মেয়র সেই প্রকল্পে নতুন ১৪টি ওয়ার্ড সংযুক্ত করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেই প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩ হাজার ৯শ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। স্থানীয় সরকার ওই প্রকল্পের বাস্তবতা যাচাইয়ে কমিটি করে দেয়। কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে ২৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের সুপারিশ করে। কিন্তু এখনো সেই বরাদ্দ অনুমোদন হয়নি। আগের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পও নেই। আর সুরমার পানি উপচে নগরী ডুবলে আমাদের করার কিছুই থাকে না। তাই সুরমা নদীর পানি প্রতিরোধেও আমরা প্রকল্প জমা দিয়েছি। প্রথমে ৩ হাজার ১শ কোটি টাকার প্রকল্প জমা দেওয়ার পর পরবর্তীকালে সেই প্রকল্প আরও বড় করা হয়। শিগগিরই ৬ হাজার ৬শ কোটি টাকা বরাদ্দের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হবে।
তিনি জানান, নগরীর বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও ভূমিকা প্রয়োজন। নগরীর অভ্যন্তরে থাকা বিসিকের দুটি শিল্পনগরীর অবহেলা, স্বেচ্ছাচারিতা নগরভবনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জলাবদ্ধতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। সিসিকের নগরভবনে স্থায়ী কোনো নগর পরিকল্পনাবিদ নেই বলেও স্বীকার করেন তিনি। বলেন, যিনি আছেন তিনি মাস্টাররোলে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে আছেন অনেকদিন ধরেই।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ যুগান্তরকে বলেন, বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে সুরমা খননের জন্য ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হয়েছে। ৫০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের প্রায় ১০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। গত বছর পরপর তিন দফা বন্যা ও প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় আর কাজ করা যায়নি।
তিনি জানান, ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার নদী খননের প্রকল্প সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই প্রকল্পে কানাইঘাট থেকে ছাতক পর্যন্ত সুরমা নদী খননের প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই প্রস্তাবটি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উপস্থাপন হতে পারে। তিনি দাবি করেন, বরাকের শাখা নদী সুরমার অনেকটা প্রাথমিক গতি সিলেট অঞ্চলে পড়েছে। ফলে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পলি, বালি, নুড়ি খুব বেশি পরিমাণে আসে নদীর পানিপ্রবাহের সঙ্গে। তাই সিলেটের প্রায় স্থানেই সুরমা ভরাট হয়ে যায় দ্রুত। সুরমার বুক ভরাট হওয়ায় পানি ধারণ ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। পানি নামলেই দুকূল ভাসিয়ে দেয়। ঘন ঘন নদী খনন জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
সিসিক ও পাউবোর নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, জলাবদ্ধতা ও বন্যা নিরসনের প্রস্তাবনা পাঠালে তা অনুমোদনে বরাদ্দে ব্যাপক গড়িমসি করে মন্ত্রণালয়। অধিক সময়ক্ষেপণের ফলে যথাসময়ে কাজ শুরু ও শেষ করা যায় না। এরই মধ্যে ঢল ও বৃষ্টির পানি সিলেট নগরীর ব্যাপক ক্ষতি করে ফেলে। অথচ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। আর সিসিক দীর্ঘ ১৪ বছরে বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। সিসিক ও পাউবো যাই বলুক নগরবাসী চায় জলাবদ্ধতা ও বন্যামুক্ত নগরী। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি না থাকলেও নগর প্রশাসন যেন এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। দ্রুত পদক্ষেপ নেয় ড্রেন, নালা পরিষ্কারসহ অন্যান্য অতিজরুরি পদক্ষেপ। প্রয়োজনে ভরাট থাকা ড্রেন, নালা, খাল, ছড়া দ্রুত পরিষ্কার ও খননে নৌবাহিনীর সহযোগিতা চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দ্রুত আবেদনের পরামর্শ সিলেটের অভিজ্ঞ ও সচেতন মহলের।