Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে ঐতিহ্য হারাচ্ছে জামদানি

অনলাইনে নিুমানের জামদানি বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে, ব্যবহারের পর আগ্রহ হারাচ্ছে অনভিজ্ঞ ক্রেতারা

Icon

মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, ডেমরা (ঢাকা)

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালি জাতির জীবন সংস্কৃতিতে অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ জামদানি শাড়ি। বর্তমানে এর আধুনিকায়ন ও মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রচলনের কথা চিন্তা শাড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুরুষের পাঞ্জাবি, ফতুয়া, মেয়েদের থ্রি-পিস ও বাচ্চাদের জামদানির জামা। একটা সময় ঈদ, পূজা-পার্বণ, বর্ষবরণ, বিয়ে-শাদি বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব কিছুতেই যেন নারীদের অনুষঙ্গ ছিল জামদানি শাড়ি। তখন এ শাড়ি ছাড়া নারীদের জীবন ছিল অনেকটাই ছন্দহীন। অথচ চলমান পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ভিড়ে বাঙালির চিরচেনা জামদানির ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছে। শহরের ছোট-বড় মার্কেট, শপিং মল, বিপণিবিতান এমনকি গ্রামগঞ্জের শাড়ি-কাপড়ের দোকানগুলোতেও এখন আর দেখা মিলে না জামদানি শাড়ির। দু’চারটে দোকানে জামদানির দেখা মিললেও ক্রেতা কম। এমন চিত্রই দেখা গেছে এবারের ঈদের কেনাকাটায়।

এখনো বাঙালি সংস্কৃতিতে বৈশাখ বরণ ও পূজা-পার্বণে নারীদের হৃদয়ের মণিকোঠায় রয়েছে জামদানি। এ ক্ষেত্রে ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক অবস্থানে ব্যক্তির রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্বের ধারাবাহিকতায় দিনে দিনে জামদানি মানুষকে প্রভাবিত করেছে। পোশাকের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা গেছে। বর্তমানে নারী-পুরুষ ও বাচ্চারা সবাই জামদানির তৈরি পোশাক পাচ্ছে সহজেই। তবে এবারের ঈদে মানুষের রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জামদানির প্রতি আগ্রহটা নেই বললেই চলে।

অভিযোগ রয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে অনলাইনে নিুমানের কমদামি জামদানি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। এতে করে ব্যবহারের পর দ্রুততম সময়ে শাড়ির বৈশিষ্ট্য নষ্ট হওয়ায় ক্রমেই আগ্রহ হারাচ্ছে অনভিজ্ঞ ক্রেতারা। এ ক্ষেত্রে বর্তমান প্রজন্মের নারী ক্রেতাদের মানসম্পন্ন টেকসই জামদানি সম্পর্কে প্রকৃত অভিজ্ঞতা না থাকায় অনলাইন থেকে শাড়ি ক্রয়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন তারা। তবে ঈদ ও পূজা পার্বণে আগের প্রজন্মে জামদানির ব্যাপক প্রচলন থাকায় মানসম্পন্ন ভালো জামদানি শাড়ি ক্রয়ের অভিজ্ঞতা ছিল সবার। এ ক্ষেত্রে আগে অফলাইনে জামদানির হাট, দোকান-পাট ও বিপণিবিতান থেকে সরাসরি বিভিন্ন ধরনের শাড়ি দেখে বাজেট অনুযায়ী ক্রয় করতেন বলে ক্রেতারা ঠকতেন না। আর জামদানি সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের অনভিজ্ঞতা ও বিদেশি সংস্কৃতির অনুসরণসহ নানা কারণে দিন দিন জামদানির ঐতিহ্যকে পিছিয়ে দিচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, দেশের বাজারে যথোপযুক্ত চাহিদা না থাকায় জামদানির হাট ও দোকানগুলোতে বিক্রিনির্ভর শাড়ি প্রস্তুতকারীসহ ব্যবসায়ীরা এখন নিজেরাই নিজ নিজ এলাকায় বিক্রি করছেন। এদিকে চাহিদা কম থাকায় এখন আর শহরের দোকানিরা জামদানি হাট ও প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আগের মতো শাড়ি কিনে বিক্রি করছেন না। এতে ওই সব ব্যবসায়ী জামদানি ও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পূর্বপরিচিতির সুবাধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাড়ির ডিজাইন প্রদর্শন করে অফলাইনে মানসম্পন্ন শাড়ি বিক্রি করছেন।

নারায়নগঞ্জ রূপগঞ্জের প্রবীণ জামদানি প্রস্তুতকারী ব্যবসায়ী ও স্থানীয় কাউসার জামদানি হাউজের স্বত্বাধিকারী মো. হামিদুল্লাহ বলেন, আগে ঈদকে কেন্দ্র করে সারা দেশে মার্কেটের জানাজানি দোকানিদের কাছে চাহিদা অনুযায়ী শাড়ি সরবরাহ করতে নির্ঘুম রাত কাটাতে হতো। কিন্তু গত ৩-৪ বছর ধরে কি যে হলো কিছুই বুঝতে পারছি না।

সরেজমিন দেখা যায়, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে ডেমরা, রামপুরা, বনশ্রী, কোনাপাড়া, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী, বেইলী রোড, বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলি, সদরঘাট, গাউছিয়া, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন শপিং মল ও বিপণিবিতানগুলোতে বেঁচাকেনার ধুম পড়েছে। দোকানিদের নিঃশ্বাস ফেলার যেন সময় নেই। বাহারি পোশাকের দোকানগুলোতে বিক্রির চরম ব্যস্ততায় বিক্রেতারা দুদণ্ড দাঁড়িয়ে বাড়তি কথা বলার সময় দিচ্ছেন না ক্রেতাদের। এ ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানসহ পশ্চিমা ডিজাইনের পোশাকের ভিড়ে ঠাঁই মিলেনি বিশ্বজুড়ে বাঙালির ঐতিহ্য বহনকারী জামদানি শাড়ির। মার্কেটে শাড়ির দোকানগুলোতে জামদানির পসরা সাজালেও এবারের ঈদে ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়নি।

আরো দেখা গেছে, বিক্রি শেষ হতে না হতে বিপণি বিতানগুলোতে নতুন করে একই ধরনের পশ্চিমা পোশাক সরবরাহ করছেন ব্যবসায়ীরা। সময়ের বিবর্তনে ক্রেতারাও চাহিদা দেখাচ্ছেন ভারত-পাকিস্তানি ও পশ্চিমা পোশাকে। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের আগে আমদানি করা গোডাউনজাত ভারতীয় পোশাকগুলো বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে। আর পাকিস্তানি থ্রি-পিসসহ বিভিন্ন ডিজাইনের দৃষ্টিনন্দন পোশাক আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে ঈদকে কেন্দ করে তাঁতিরা নতুন নতুন নজরকারা ডিজাইনের জামদানি তৈরি করলেও বিদেশি ও পশ্চিমা ডিজাইনের পোশাকের পাশে জায়গা মেলেনি দেশি জামদানির। অলস সময় পার করতে দেখা গেছে বেইলীরোডসহ নামজাদা মার্কেটগুলোর জামদানি শাড়ি দোকানিদের।

এ বিষয়ে ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজা মার্কেটের সৌমিতা শাড়ি হাউজের মালিক মল্লিক মোর্শেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বাঙালি মেয়ে ও নারীদের রুচির পরিবর্তন ঘটেছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। একটা সময় ঈদ এলে গ্রাম ও শহরের গৃহিণীরা অন্তত একটি জামদানি শাড়ি কিনতেন। এমনকি মা-বোনসহ পরিবারের সব নারীরা ম্যাচিং করে বয়স অনুযায়ী যথাপোযুক্ত নকশাসম্পন্ন জামদানি কিনতেন। আর প্রতিযোগীতামূলক জামদানি সংগ্রহই ছিল নারীদের ঈদের প্রকৃত আনন্দ। বর্তমানে টেলিভিশনে বিভিন্ন সিরিয়াল দেখে দ্রুত রুচির পরিবর্তন ঘটে ভারত ও পাকিস্তান এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টতা। এতে বাঙালি নারীদের অনুষঙ্গ জামদানি আজ ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

সদরঘাটের রুমা শাড়ি বিতানের মালিক মাহাদী হাসান বলেন, গত কয়েক বছর আগেও বরিশাল, স্বরূপকাঠি, ঝালকাঠি ও গৌরনদীসহ দক্ষিণাঞ্চলের ক্রেতারা ঈদের সময় সদরঘাট থেকে প্রচুর পরিমাণে জামদানি কিনে নিয়ে যেত। বর্তমানে তাদের আর দেখা মিলছে না।

এ বছর কি জামদানি শাড়ি কিনবেন এমন প্রশ্নের জবাবে যমুনা ফিউচার পার্কে শাড়ি কিনতে আসা প্রবীণ ক্রেতা সালমা ইসলাম বলেন, একটা সময় ছিল প্রতি ঈদেই জামদানি শাড়ি কিনতাম। কেন যেন এখন আর জামাদানি শাড়ি কেনা হয় না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে শাড়ির চেয়ে থ্রি-পিস পরাতেই স্বাচ্ছন্দ্য মনে হয়। এ ক্ষেত্রে বয়সভেদে পাকিস্তানি লোন বা ভারতীয় থ্রি-পিস পরায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা। আর নতুন প্রজন্মরা জামদানি সম্পর্কে খুব একটা ভালো ধারণা রাখে না। অধিকাংশই তুর্কি, ভারত ও পাকিস্তানিসহ বিভিন্ন দেশের টিভি সিরিয়াল দেখে পোশাকে রুচির পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। পাশাপাশি পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় আমাদের মাঝ থেকে জামদানি হারাতে বসেছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এক সময় শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত ও অভিজাত পরিবারের নারীদের মধ্যেই জামদানির প্রচলন ছিল। পরবর্তিতে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এটি মধ্যবিত্তসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একটা সময়ে জামদানির চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেলেও গত ২-৩ বছর ধরে ঈদের সময়ে জামদানির চাহিদা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে ইউনেস্কো জামদানিকে ‘মানবতার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৬ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) কর্তৃক ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) আইনের আওতায় জামদানি শাড়িকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে তেমন একটি সুবিধা করতে পারেনি জামদানি শাড়ি। ভারতের তামিলনাড়ুতে ‘জামদানি’ নামে একটি ভিন্ন ধরনের বস্ত্র পাওয়া যায়, যা বাংলার জামদানির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আর বাংলাদেশের এ অঞ্চলেই শুধু তৈরি হয় হাতে বোনা জামদানি, যা বিশ্বের দরবারে অনেক কদর। আবুল ফজল আইন-ই-আকবরি-তে উল্লেখ করেন, মুঘল যুগে ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে পরিচিত এই বস্ত্রটি ছিল বাংলার সর্বাধিক মূল্যবান রপ্তানিপণ্য। সে সময় ঢাকা, সোনারগাঁ ও ডেমরার তাঁতিরা সম্রাটের জন্য ‘তরবুজি’, ‘চন্দ্রমল্লিকা’ ও ‘ময়ূরপঙ্খী’ নকশার জামদানি বুনতেন, যা আজও প্রচলিত। আবুল ফজলের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৬শ শতকে জামদানি শিল্পে ৫০ হাজারের বেশি কারিগর নিযুক্ত ছিলেন। অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দের মতে, ১৬-১৭শ শতকে বাংলা থেকে বছরে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজারটি জামদানি শাড়ি রপ্তানি হতো, যার মূল্য ৮-১২ লাখ রুপির মধ্যে ছিল।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের (ভুলতা রূপগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ) ফিল্ড সুপারভাইজার (ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ অফিসার) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিশ্বজুড়ে জামদানির আরও ব্যাপকতা ছড়িয়ে দিতে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। তবে দেশের বাজারে অন্য পোশাকের ভিড়ে জামদানি পিছিয়ে পড়ারোধে আরও বেশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড কর্তৃক নরসিংদীতে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাশাপাশি ফ্যাশন ডিজাইন ও জামদানি তাঁতিদের বিশেষ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে রং ও ডিজাইন সম্পর্কে নতুন নতুন ধারণা দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কোর্সভিত্তিক। তবে জামদানি তাঁতিরা তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে সময় নষ্ট হবে মনে করে ট্রেনিং দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। কারণ ট্রেনিংয়ে সময় তাদের যে স্বল্প ভাতা দেওয়া হয় এতে তাদের সাংসারিক চাহিদা পূরণ না হওয়ার কারণে তারা কোনোভাবেই ট্রেনিং দিতে আগ্রহ দেখায় না। এ বিষয়ে সরকারি নজরদারি বাড়লে এবং অর্থনৈতিকভাবে জামদানি শিল্পীদের সহযোগিতা করতে পারলে বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে জামদানিতে আধুনিকতা আনা সম্ভব।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম