
প্রিন্ট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২০ এএম

আরও পড়ুন
প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা)। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগকে স্বচ্ছ ও দক্ষভাবে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, প্রযুক্তিনির্ভর নীতিমালা ও টেকসই খাত গঠনে কাজ করছেন।
সম্প্রতি নিজ দপ্তরে যুগান্তরের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ খাতের নানা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন-সাইফ আহমাদ।
যুগান্তর : সরকারে যোগদানের পর আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? আগে আপনি এ বিভাগের নীতি উপদেষ্টা ছিলেন।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : দেখুন, আমি নভেম্বর থেকে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে কাজ শুরু করি। সে সময় পলিসি অ্যাডভাইজর হিসাবে সংস্কার ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করি। সে থেকেই প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে দলীয় পরামর্শকদের মাধ্যমে দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এজন্য আমরা অনৈতিক পরামর্শকদের বাদ দিয়েছি এবং প্রতিটি প্রকল্পের পারফরম্যান্স গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছি। প্রাথমিকভাবে ২১টি প্রকল্প পর্যালোচনা করে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাতিল করা হয়, যার মোট পরিমাণ ২০০০ থেকে ২১০০ কোটি টাকা। পাশাপাশি পিডি (প্রকল্প পরিচালক) ও ডিপিডি (উপপরিচালকদের) কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায়, আইসিটির মাস্টারপ্ল্যান এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন রোডম্যাপের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি দপ্তর ও সংস্থাকে স্পেসিফিক টাস্ক (সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব) দেওয়া হয়েছে, যা তাদের কার্যক্রমকে আরও সুসংগঠিত ও ফলপ্রসূ করে তুলছে। বর্তমানে আইসিটি খাতে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।
যুগান্তর : এটুআই, আইডিয়া, স্টার্টআপ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন? কতটুকু সমাধান হয়েছে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : প্রকল্পগুলোর অনিয়ম তদন্ত করে বেশ কিছু দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে আইডিয়া প্রকল্পে দলীয় পরিচয়ে প্রায় হাজার জনকে এসএমই ঋণ দেওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে। এমনকি ৪০ জনের বেশি এমপি-মন্ত্রীর পরিচয়ে ১০ লাখ টাকা করে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি দুর্নীতি। বিষয়গুলো ডকুমেন্টেড, সব প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। এরই মধ্যে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত পরামর্শকদের বাদ দেওয়া হয়েছে, বাজে ও অপচয়কারী প্রকল্পগুলো বন্ধ করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে কাজ চলছে, যাতে স্বজনপ্রীতি বা রাজনৈতিক স্বার্থে অর্থ বণ্টনের পথ চিরতরে বন্ধ করা যায়।
যুগান্তর : হাইটেক পার্কগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলো পার্কের প্রয়োজন আছে কিনা? কীভাবে এসব পার্কগুলোকে কার্যকর করবেন?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : আগের সরকার হাইটেক পার্কগুলোর ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে নানারকম অনিয়ম করেছে। যে কারণে হাইটেক পার্কগুলোর অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শহর থেকে অনেক দূরে। ফলে বেশির ভাগ পার্ক কার্যকরভাবে পরিচালনা করা কঠিন হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি কোম্পানিকে পার্কগুলোতে যুক্ত করতে কাজ করছি। দেখুন, মানবসম্পদ উন্নয়নের দিক থেকে হাইটেক পার্কগুলোর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। এগুলোর কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য আমাদের মূল লক্ষ্য সফট স্কিল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যেমন কিছু জায়গায় দলীয় স্বার্থে অফিস বানানো হয়েছে, যা পার্কগুলোর আসল উদ্দেশ্যকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এগুলো সমাধান করে হাইটেক পার্কগুলোর পরিকাঠামোকে যথাযথ প্রযুক্তিগত সুবিধায় রূপান্তর করা গেলে এগুলো লাভজনক ও কার্যকর হতে পারে।
যুগান্তর : ফ্রিল্যান্সারদের দীর্ঘদিনের দাবি দেশে পেপ্যাল চালু করা। কবে পেপ্যাল আসবে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে পেপ্যাল চালুর বিষয়ে আলোচনা চলছে, তবে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ এখনো নিশ্চিত হয়নি। মূল চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে অনলাইন জালিয়াতি প্রতিরোধে ২৪/৭ আর্থিক নিরাপত্তা সেবা (BFIU Support) না থাকা, নির্ভরযোগ্য ঠিকানা যাচাই ব্যবস্থার অভাব এবং একমুখী লেনদেন নীতি। পেপ্যাল শুধু একটি পেমেন্ট গেটওয়ে নয়, এটি একটি দ্বিমুখী লেনদেন প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে একমুখী লেনদেন অনুমোদন দেয়, যা পেপ্যালের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি পেপ্যালের বাংলাদেশে না আসার পেছনে ভারতের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা থাকায়, অনেক সময় বাংলাদেশের অনুরোধে বিলম্ব ঘটে বা বাধার সৃষ্টি হয়। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার, মার্কিন দূতাবাস ও সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে পেপ্যালকে আনতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তবে ভারতীয় প্রভাব ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
যুগান্তর : বাংলাদেশে স্টারলিংক আসা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতেই এটি আনা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : স্টারলিংকের অনুমোদন প্রক্রিয়া ট্রাম্প প্রশাসন আসার আগেই শুরু হয়েছে, তাই এর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্ন ওঠে না। যদিও বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম, গুণগত মান অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে। উচ্চমানের ইন্টারনেট না থাকায় ব্যবসায়ী, ফ্রিল্যান্সার ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সমস্যায় পড়েন। এছাড়া, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক ঘাটতি ও লোডশেডিংয়ের সমস্যা বিদ্যমান। স্টারলিংক দ্রুতগতির স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সরবরাহ করে এসব সমস্যা কমাতে সহায়তা করবে।
যুগান্তর : স্টারলিংক বাংলাদেশে এলে স্থানীয় অপারেটরদের ব্যবসায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : স্টারলিংকের আগমনে স্থানীয় আইএসপি ও মোবাইল অপারেটরদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, বিশেষত যারা নিম্নমানের ইন্টারনেট সেবা দেন। তবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আইএসপিগুলোকে তাদের সেবার মান উন্নত করতে হবে এবং নিরবচ্ছিন্ন ও উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে প্রিমিয়াম গ্রাহকদের ধরে রাখতে, তাদের নতুন প্রযুক্তি ও সেবা উন্নয়ন করা জরুরি। স্টারলিংকের মূল প্রতিযোগিতা দামে নয়, বরং গুণগত মানে হবে। তাই স্থানীয় কোম্পানিগুলো যদি উন্নত মানের ইন্টারনেট সেবা দিতে পারে, তাহলে তারা বাজারে টিকে থাকতে পারবে।
যুগান্তর : সরকার ইন্টারনেট বন্ধের সুযোগ রাখছে না বলে জানিয়েছে। তবে আড়িপাতা বা নিয়ন্ত্রণ কি থাকবে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : ইন্টারনেট বন্ধের কোনো সুযোগ সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য রাখা হয়নি। আইন সংশোধনের মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। তবে আড়িপাতার বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আইনানুগ হলে তা গ্রহণযোগ্য। স্টারলিংকসহ যে কোনো অপারেটরের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে। সরকার টেলিযোগাযোগ আইন সংশোধন করে আড়িপাতার অপব্যবহার রোধের ব্যবস্থা নিতে পারে, যাতে নাগরিকদের গোপনীয়তা সুরক্ষিত থাকে।
যুগান্তর : বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ এখনো অনেকটাই ভারতনির্ভর। এ নির্ভরতা কমানোর কোনো কার্যকর পরিকল্পনা আছে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : হ্যাঁ, ভারতনির্ভরতা কমাতে আমরা ‘ফিফটি-ফিফটি’ নীতিতে গিয়েছি, যাতে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ব্যান্ডউইডথ সরাসরি সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে আসে। পাশাপাশি সাবমেরিন কেবলের দাম কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি। এ ছাড়া সি-মি-উই ৬ কেবল সিস্টেমে আমাদের বিশাল ২০ টেরাবাইট অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি রয়েছে, যেটি আরও কার্যকরভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছি।
যুগান্তর : পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কি বড় কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন? প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ ও নীতিগত জটিলতা প্রভাব ফেলছে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নানা ধরনের বাধার মুখোমুখি হচ্ছি। অভ্যন্তরীণ, নীতিগত ও কাঠামোগত জটিলতা রয়েছে। তবে আমরা এগুলোকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিচ্ছি। কাজের চাপ অনেক, নাগরিকদের প্রত্যাশা বেশি, তবে আমাদের লক্ষ্য দেশ ও জনগণের কল্যাণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। আমরা সাইবার সিকিউরিটি অর্ডিন্যান্স পাশ, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন এবং ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা থাকলেও আমরা নীতিগত পরামর্শ দিচ্ছি এবং সমীক্ষার মাধ্যমে সমাধান খুঁজছি। যে কোনো চাপ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাব। সে মানসিক দৃঢ়তা আমাদের আছে। আমরা আশাবাদী, বছরের মাঝামাঝি থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারব এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হব।
যুগান্তর : বাংলাদেশে ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছে বাংলালিংক। এ সময়ের মধ্যে শুধু একবার লাভ ঘোষণা করেছে, আর বাকি সময় ধরে তারা লোকসানের দাবি করেছে। অথচ তাদের সিইও এবং সিএক্সও লেভেলের কর্মকর্তাদের অত্যধিক বেতন-ভাতা নিয়ে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : এ ধরনের বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কর ফাঁকি বা আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য কৌশলগতভাবে লোকসানের হিসাব দেখায়। তারা মূল কোম্পানি বা সহযোগী কোম্পানির মধ্যে লেনদেনের মাধ্যমে মুনাফা অন্য দেশে স্থানান্তর করতে পারে। এ ধরনের অপারেটরদের আর্থিক বিবরণী যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক মানের অডিট প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিরীক্ষা করা গেলে, প্রকৃত চিত্রটা বেরিয়ে আসতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই তারা যেটা করে ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরে বসে ডিল করে এবং দেখা যায় যে, অনেক বেশি দামে যন্ত্রপাতি ক্রয় দেখিয়ে থাকে। এ বিষয়টি মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত কিনা সেটাও তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।