
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১৭ এএম
রাজশাহীতে আলুর দামে অস্বাভাবিক দরপতন
জমিতে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকা
ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে আলু * অনেকে জমি থেকে তুলছেন না

আনু মোস্তফা, রাজশাহী
প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
রাজশাহীতে আলুর দামে আরেক দফা ধস নেমেছে। গত তিনদিনে রাজশাহীর মাঠে ৮ টাকা থেকে ৯ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, গত ৩০ বছরে মাঠে আলুর দামে এমন বিপর্যয় তারা দেখেননি। অনেককে বিক্রি করতে না পেরে আলু ফেলে দিচ্ছেন ভাগাড়ে বা খোলা মাঠে। অনেকেই জমি থেকে আলু তুলছেন না। তারা আরও বলেন, যে টাকায় শ্রমিক ভাড়া করে আলু তোলা হচ্ছে তা বিক্রি করে শ্রমিক খরচই উঠছে না। হিমাগার মালিক ও সিন্ডিকেটের কারণে চাষিরা পথে বসেছেন। হিমাগার মালিক ও মজুতদারদের কারসাজিতে আলুর অস্বাভাবিক দরপতন ঘটেছে।
কয়েকজন চাষি জানান, জেলায় এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে স্থানীয় বা চালানি মোকামে আলুর দাম নেই। এখন আলু বেচে কৃষকের জমি ইজারার খরচই উঠছে না। যেসব কৃষক হিমাগারের অগ্রিম বুকিং পেয়েছিলেন তারাও হিমাগারে আলু রাখতে পারছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। অনেকেই অগ্রিম কোনো বুকিং ছাড়াই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জোর করে আলু হিমাগারে ঢোকাচ্ছেন। ফলে অসহায় অনেক কৃষকের আলু জমিতেই পড়ে থাকছে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের আলুচাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ফেব্রয়ারির শেষদিক থেকে আলু তোলা শুরু হয়েছে। প্রথমদিকে জমিতে আলুর কেজি ছিল ১২ থেকে ১৩ টাকা। এখন তা ৮ থেকে ৯ টাকাতে নেমে এসেছে। এবার তার জমি বিঘায় ফলন হয়েছে ৫৫ বস্তা। সে হিসাবে এক বিঘায় এবার আলুর ফলন হয়েছে ৬৯ মন। জমিতে আলু বিক্রি হচ্ছে ৯ টাকা কেজি দরে। এক বিঘা জমির আলু বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে ২৪ হাজার ৮৪০ টাকা। তিনি জানান, প্রতি বিঘা আলুর জমি ইজারা নিয়েছিলেন ২৭ হাজার টাকায়। এক বিঘার আলু বিক্রি করে জমি ইজারার খরচ উঠছে না। এক বিঘায় আলু চাষে বীজ, শ্রমিক খরচ, সেচ সার কীটনাশক ও পরিবহণ ভাড়া বাবদ খরচ হয়েছে আরও ৩৫ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় এবার লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৮ হাজার টাকা।
মোহনপুরের বসন্তকেদার গ্রামের চাষি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘হিমাগারে অগ্রিম বুকিং দেওয়ার পরও আলু দিতে পারিনি। হিমাগার মালিক বলেছেন, আলু নেওয়া যাবে না। আমাদের বুকিংগুলো কেটে দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে দেওয়া হচ্ছে। হিমাগারে আলু রাখতে না পেরে জমিতেই রেখে দিয়েছি।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ৩৭ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূল থাকায় প্রায় ৪০ হাজার হেক্টরে আলুর আবাদ হয়। কৃষি বিভাগ বলছে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ১১ লাখ টন আলু উৎপন্ন হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজশাহীতে ৩৬টি হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৪ লাখ টন। এখন প্রায় ৭ লাখ টন আলু থেকে যাচ্ছে সংরক্ষণের বাইরে। মূলত বিপুল পরিমাণ এই আলু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।
জেলার তানোরের আড়াদিঘি গ্রামের আলু চাষি মজিবুর রহমান বলেন, আমার ৪০ বিঘা জমিতে এবার ৭ হাজার বস্তা আলু হয়েছে। রহমান কোল্ড স্টোরেজে অগ্রিম বুকিং দিয়েছিলাম। অর্ধেক আলু হিমাগারে তোলার পর আর আলু নিচ্ছেন না ম্যানেজার। এক সপ্তাহ আগে তোলা আলু জমিতেই পড়ে আছে। তিনি অভিযোগ করেন, ‘দলীয় প্রভাব খাটিয়ে একটি সিন্ডিকেট বুকিং ছাড়াই জোর করে আলু হিমাগারে দিচ্ছে। দলীয় সিন্ডিকেট আলু রাখার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলে কৃষকদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।’
অভিযোগের বিষয়ে রহমান কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার আব্দুল মুনিম বলেন, দলীয় লোকেরা এসে কিছু আলু রাখতে চাচ্ছেন। আমরাও তাদেরকে না করতে পারছি না। তবে সেটার পরিমাণ বেশি না। হিমাগারের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এবার রাজশাহীতে লক্ষ্যমাত্রার বেশি আলু হয়েছে। এ কারণে হিমাগারগুলোতে আলু রাখার জায়গা হচ্ছে না।
মোহনপুর উপজেলার জাহানাবাদ এলাকার আলুচাষি জাহিদুল করিম বলেন, আমরা কৃষক সবদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত। এবার ফলন হয়েছে, কিন্তু লাভ হলো না। কোল্ড স্টোরেজে জায়গা পাচ্ছি না। আবার গতবছর কেজিপ্রতি কোল্ড স্টোরেজ ভাড়া ছিল ৪ টাকা কেজি এবার আট টাকা করা হয়েছে। এই বিপুল লোকসান কাটিয়ে ওঠা কঠিন।
আলুর অস্বাভাবিক দরপতন বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোতালেব হোসেন জানান, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে। সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেছে। ফলে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে।