দেশীয় পোশাকে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ট্যাগ
চট্টগ্রামে ঈদ মার্কেটে ক্রেতা ঠকানোর প্রতিযোগিতা
সেলিম পাঞ্জাবিকে ২ লাখ টাকা জরিমানা

আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঈদ সামনে রেখে চট্টগ্রামের মার্কেটগুলোতে তৎপর অসাধু ব্যবসায়ীরা। কাপড়ের মার্কেট থেকে শুরু করে ফলের মার্কেট- সব জায়গাতেই নানা কৌশলে ক্রেতাদের ঠকানোর প্রতিযোগিতা চলছে। পুরনো কাপড়ে নতুন ট্যাগ লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার মার্কেটগুলোতে আমদানি মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে পণ্য। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর প্রতিদিন বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে এমন প্রতারণার চিত্র উদঘাটন করছে। তবে এতে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না অসাধু ব্যবসায়িদের। তাদের কাছে অসহায় ক্রেতারা।
রোজা শুরুর পর চট্টগ্রামে বিভিন্ন মার্কেট, আড়ত ও বাজারে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন ও অধিদপ্তরের টিম। অভিযানে পণ্যের কেনা-বেচায় বিস্তর অসঙ্গতি পায় টিমের সদস্যরা। দেখা গেছে চট্টগ্রামে কাপড়ের মার্কেট ‘ফিক্সড প্রাইস’ হিসেবে পণ্যের গায়ে দাম ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকরাও দরকষাকষি ছাড়াই এসব পণ্য কিনছেন। নিয়ম অনুযায়ী পণ্যের গায়ে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু অযৌক্তিক ও অবিশ্বাস্য মূল্যের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ায় গ্রাহকরা প্রতারিত হচ্ছেন। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাইস ট্যাগ না লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোড দিয়ে পণ্য বিক্রি হচ্ছে।
শনিবার সকালে রিয়াজউদ্দিন বাজারের সেলিম পাঞ্জাবী মিউজিয়াম নামে একটি একটি প্রতিষ্ঠানে হানা দেয় চট্টগ্রাম ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সেখানে তারা দেখতে পান, ২-৩ বছর আগের পুরানো দেশি পাঞ্জাবী ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ট্যাগ লাগিয়ে বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত দামও নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে নেতৃত্বে দেওয়া চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, আমরা রিয়াজউদ্দিন বাজারের সেলিম পাঞ্জাবী নামে প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালিয়েছি। পাঞ্জাবীগুলো দেশে তৈরি। কিন্তু তারা ট্যাগ দিয়ে রাখছে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’। বিদেশী বললে তারা অতিরিক্ত দাম আদায় করতে পারেন। আমাদের সোর্সের কাছে তারা নিশ্চিত করেছিলেন এখানে ৩০ হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবীও আছে। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এখন তা স্বীকার করছেন না। এখন তারা বলছেন, এখানে ৬-৭ হাজার টাকার বেশি দামের পাঞ্জাবী নেই। বিদেশী বললে প্রতারণা করার একটি সুযোগ তৈরি হয়। ভারত থেকে আমদানি করেছেন- এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কাগজপত্র দেখাতে বলেছিলাম। তারা কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেন নি। এমনকি এসব পাঞ্জাবীর ক্রয়মূল্য কত তাও দেখাতে পারেননি।
এসব অপরাধে সেলিম পাঞ্জাবী নামে প্রতিষ্ঠানটিতে ২ লাখ টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিতপ্তরের আভিযানিক টিম। একই অপরাধে পরিস্থান নামে অপর এক প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা কোন অবস্থাতে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারেন না। পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারেন শুধু মাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। আর আমদানিকৃত পণ্য হলে আমদানিকারক। এর বাইরে কারো পণ্যের দাম নির্ধারণের এখতিয়ার নেই।
চট্টগ্রাম নগরীর অভিজাত মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ বা পাইকারি মার্কেটের সঙ্গে এসব মার্কেটের দামে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। যে পণ্যটি পাইকারি মার্কেটে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়, সেটি অভিজাত মার্কেট ৫ থেকে ৭ হাজার টাকাও বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের অভিযাগ, দোকানি বা প্রতিষ্ঠান মালিকরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৫৬’ অনুযায়ী, বস্ত্র নিত্য প্রয়োজনীয় একটি পণ্য। কিন্তু এর দাম নিয়ন্ত্রণে কেউ নেই। সরকারি সংস্থা ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর’ মাঝে মধ্যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কিছু জরিমানা করলেও দাম নিয়ন্ত্রণ বা মনিটরিংয়ের বিষয়ে তাদের কোনও ব্যবস্থা নেই। সূত্র আরও জানায়, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। সুপার শপ থেকে শুরু করে সাধারণ দোকানেও নির্ধারিত ওই দামেই পণ্য বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে পণ্যের দামে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। অভিজাত মার্কেটগুলোতে ফিক্সড প্রাইসের নামে চলছে ভয়াবহ জালিয়াতি।
একাধিক ক্রেতা জানান, ঈদ মার্কেট ঘিরে চলছে অসাধু ব্যবসায়িদের দাপট। মার্কেট ও শপিংমলগুলোতে নতুন পণ্যের পাশাপাশি পুরোনো পণ্যকেও নতুন বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন ট্যাগ লাগিয়ে। কিন্তু ক্রেতারা বুঝতে পারছেন না কোনটা নতুন আর কোনটা পুরোনো। বিশেষ করে ডিসকাউন্টের দোকানগুলোতে পুরোনো পণ্য বিক্রি চলছে বেশি। ‘ঈদ কালেকশন’ ব্যানার টানিয়ে এই প্রতারণা করা হচ্ছে।
নগরীর মিমি সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা সাদ্দাম হোসেন বলেন, টেরিবাজারে যেসব থ্রি-পিসের দাম ১ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা; মিমি সুপার মার্কেটে একই মানের থ্রি-পিসের দাম নেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। টেরি বাজারে পাইকারি বাজারে যে শাড়ি আড়াই হাজার টাকা; একইমানের শাড়ি মিমি সুপার মার্কেট, সানমার শপিং সেন্টারসহ অভিজাত শপিং মলে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। হকার মার্কেট থেকে কাপড় কিনে নিয়ে নিউ মার্কেটের দোকানগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে দুই-তিনগুণ দামে।