
প্রিন্ট: ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪৮ পিএম
মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ শিক্ষার্থীরা জিম্মি

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চেয়ারম্যান পদ দখলসহ বিভিন্ন নিয়োগ ও দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন অনেকে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তারা এখন নিজেদের ভোল পালটানোর চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করলেও কেউ তা বলার সাহস করছেন না। ফলে বিতর্কিত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে এই স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। জানা যায়, কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক ১৭ বছর ধরে চেয়ারম্যানের পদ দখল করে আছেন। তিন বছর পরপর এই পদে পরিবর্তন নিয়ম থাকলেও সেটি করা হয়নি। এমনকি সম্প্রতি তিনি প্রভাব কাটিয়ে অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি নিয়েছেন। তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি প্রোগ্রামের কো-অর্ডিনেটর হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পরীক্ষা পাশ করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী টাকা দেন তাদের নির্দিষ্ট কক্ষে তিনি পরীক্ষা নেন। এরপর উত্তরপত্র পাঠিয়ে দেন। এক্ষেত্রে পরীক্ষার হল নিয়ন্ত্রণ রাখতে কলেজের কোনো শিক্ষককে তিনি পরিদর্শক হিসাবে দায়িত্ব দেন না।
এছাড়া আব্দুর রাজ্জাক নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইনকোর্স ও ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে তার মোহাম্মদপুরে আটতলা একটি বাড়ি রয়েছে। শিক্ষক পল্লিতে দুটি ফ্ল্যাট ও আদাবরে একাধিক প্লট রয়েছে বলে জানা গেছে। সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়ে তিনি এত অর্থ সম্পদের কিভাবে মালিক হলেন, সেটি এখন সবার কাছে প্রশ্ন।
এছাড়া আইসিটি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম সুমনের বিরুদ্ধে কম্পিউটার ল্যাবের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে বিভাগে নামে মাত্র ল্যাব থাকায়, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আইসিটি ল্যাব ক্লাস করতে পারেন না। তিনি বিভাগে কোনো পুরুষ শিক্ষক নিয়োগ দেননি। বর্তমানে বিভাগে শতভাগ নারী শিক্ষকদের অফিস শেষের পরও সময়ক্ষেপণ করান চেয়ারম্যান। আশরাফুল ইসলাম বিবাহিত হওয়ার পরেও প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারীর মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সর্ম্পকে জড়ান। পরে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগীর পরিবার লিখিত অভিযোগ দিলে তৎকালীন অধ্যক্ষ তাকে বরখাস্ত করেন। পরে ওই মেয়েকে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে চাকরি ফিরিয়ে নেন।
দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মর্জিনা বেগম স্কাউটের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি গভর্নিং বডির সদস্যদের ম্যানেজ করে কলেজের টাকায় বিদেশ ভ্রমণে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে শিক্ষক লাঞ্ছিত করার অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন নিজেকে ভারতের দালাল বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। নিয়ম ভঙ্গ করে তিনি তাহমিনা জয়নব প্রীতি নামে এক নারীকে স্থায়ী শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন।
কলেজের বিদ্যোৎসাহী সদস্য কাজী মাহবুব তার স্ত্রী মর্জিনা বেগমকে অবৈধভাবে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন। এছাড়া কাজী মাহবুব ব্যক্তিগত কাজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহার ও প্রতিষ্ঠানের টাকা নানাভাবে আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বেসরকারি কলেজ গভর্নিং বডির রেগুলেশন অনুযায়ী শিক্ষক প্রতিনিধি (টিআর) শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়া আব্যশক। এই শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন না দিয়ে এই পদ দখল করেছেন ইসলাম শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক লিয়াকত আলী। সাবেক ছাত্রদল নেতা লিয়াকত ভয়ভীতি দেখিয়ে এই পদ দখল করে আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরপর তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি ও উপাধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) পদও বাগিয়ে নেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, পতিত আওয়ামী সরকারের পতনের পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শৃঙ্খলা নেই। শিক্ষকদের ভোট ছাড়া কিভাবে অবৈধ শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়, তা বোধগম্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে চেয়ারম্যান পদ দখলে নেওয়া কিছু ফ্যাসিস্টের লোক এখনো বহালতবিয়তে রয়েছে। এটি দ্রুত নিয়মের মধ্যে আসা উচিত।
সমাজকর্ম বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে বলেন, ফিল্ড ওয়ার্কের নামে শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক জোর করে টাকা আদায় করেন। অন্যথায় শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে তিনি এখন বিএনপির নেতা সেজেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কমিটিতে নিজের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন তিনি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সেগুলো সত্য নয়। আমি নিজেকে ভালো মানুষ মনে করি। আমি নিট অ্যান্ড ক্লিন। দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান পদে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা কলেজের অধ্যক্ষ ভালো বলতে পারবেন।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এইচএম ওয়ালিউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষকদের ভোট ছাড়া শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন করার বিষয়টি আমার সময় হয়নি। আমি সদ্য নিয়োগ পেয়েছি। তাই বিষয়টি দেখব। তবে দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যরা দেখেন।
সম্পর্কিত খবর

