সাক্ষাৎকার: ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার, ইউনিলিভার
লেখাপড়ায় এগিয়ে থাকলেও কর্মস্থলে পিছিয়ে নারীরা: আমিরা আল মুক্তাদির

ইউনিলিভারের ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার আমিরা আল মুক্তাদির। ফাইল ছবি
কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বের সমন্বয়কে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন ইউনিলিভারের ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার আমিরা আল মুক্তাদির। তার মতে, পরিবার ও কর্মস্থলের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গিয়ে অনেক নারী নেতৃত্ব থেকে ঝরে পড়েন। তবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নারীদের আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে যুগান্তরকে দেওয়া বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্যে উঠে আসে এসব তথ্য। ২০১৭ সালে ইউনিলিভারের সঙ্গে যুক্ত হন আমিরা আল মুক্তাদির। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাইনান্স কন্ট্রোলারের দায়িত্ব পালন করছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন বহুজাতিক এই কোম্পানির ফাইন্যান্স শাখার।
আমিরা বলেন, যতটা সম্ভব সংসার সামলাব, একইসঙ্গে নিজেকে প্রমাণও করতে হবে; যত কষ্টই হোক না কেন। করপোরেট দুনিয়ায় সরাসরি ভেদাভেদ না থাকলেও এর বাইরে কিছুটা ভেদাভেদ রয়েছে। ফলে অনেক সময় নারীদের নিজেদের যোগ্যতা আরও বেশি প্রমাণ করতে হয়। অর্থাৎ, মেয়েদের পরিশ্রমের মাত্রা একটু বেশি হলেও তবু হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। মালটিন্যাশনাল ও এফএমসিজি খাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ ভালো। তবে নেতৃত্বের আসনে পৌঁছানো বাইরের বিশ্বের তুলনায় এখানে বেশ চ্যালেঞ্জিং। তার মতে, পড়াশোনায় মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও কর্মজীবনে একপর্যায়ে অনেকেই পিছু হটেন। কারণ, বিয়ের পর সংসারে দায়িত্ব বেড়ে যায়। ক্যারিয়ার ও পরিবার একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে অনেকের জন্য পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। সাধারণত, স্বামীরা চাকরি ছাড়েন না, ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রীকেই কর্মজীবন থেকে সরে আসতে হয়।
আমিরা বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত একজন নারীকে মাতৃত্বকালীন ছুটির পর ফিরে এলে তার আগের পদে বা আরও ভালো অবস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়া। পাশাপাশি, তাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে। যেমন ইউনিলিভারের ডে-কেয়ার সুবিধা। যদি একজন কর্মী মাতৃত্বকালীন ছুটির পর তার নির্ধারিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পান, একই সঙ্গে যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা পান, তাহলে তিনি সহজেই কাজের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন এবং কর্মজীবন থেকে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা কমে যায়। তখন ড্রপ ডাউনটা হয় না।
আমিরা মনে করেন, করপোরেট সুবিধার পাশাপাশি পরিবারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, যদি পরিবার থেকে কেউ বাচ্চাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়, তাহলে নারীরা কর্মস্থলে ফিরে আত্মবিশ্বাস অনুভব করতে পারেন। একই সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিশ্চিত করা উচিত, মাতৃত্বকালীন ছুটির পরও একজন কর্মী যেন অনুভব করতে পারেন ছুটিতে যাওয়ার আগে আমি যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম এখনো ততটাই আছি। কিন্তু যদি তাকে এমন কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা তার দক্ষতা ও অবস্থানের সঙ্গে মানানসই নয়, তাহলে অনেক নারী পরিবার ও সন্তানের যত্নকেই অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হন। তিনি জানান, বাইরের দেশে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ডে-কেয়ারে পাঠানোর একটি প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি রয়েছে। তবে বাংলাদেশে এখনো এই সংস্কৃতি পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনিলিভারে যোগদানের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমিরা বলেন, আমি প্রথমে মার্কেটিং ফাইন্যান্স বিজনেস পার্টনার হিসাবে জয়েন করি। এরপর পদোন্নতি পেয়ে ফাইন্যান্স কন্ট্রোলার হিসাবে বর্তমানে কাজ করছি। আসলে আমি কোনো বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হইনি। পরিবার বরাবরই পড়াশোনায় সমর্থন করেছে। ছোটবেলা থেকেই জানা ছিল, একদিন কর্মজীবনে প্রবেশ করব। পরিবার থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা পাইনি, শ্বশুরবাড়ি থেকেও নয়, এমনকি আমার স্বামীও সব সময় সমর্থন করেছেন।
নিজের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, দাবি করেন আমিরা মুক্তাদির। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম চাকরিতে যোগ দিই, তখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি। সেই পরিস্থিতিতে নিজের দক্ষতা ও পেশাগত স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, পরিকল্পনা ছিল ফাইন্যান্সে ক্যারিয়ার গড়ব এবং সে পথেই এসেছি। যদি কেউ মার্কেটিংয়ে যেতে চায়, তাহলে সে সেদিকেই যাবে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে ‘আমি নারী, তাই এটা করব’ এমন চিন্তা না করে বরং যে বিষয়ে আগ্রহ, সেটিই বেছে নেওয়া উচিত। শুধু মেয়ে বলেই শিক্ষক হওয়া বা শিক্ষকতা করলে সুবিধা হবে, ৫টার পর বাসায় ফিরতে পারব-এমন হিসাব কষার চেয়ে, পছন্দের পেশায় যাওয়া-ই উচিত। ক্যারিয়ারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মূল ভাবনাটি হওয়া উচিত কী করতে চাই এবং সে অনুযায়ী পড়াশোনা করা।