Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয় গরিবের কর্মসূচি

হামিদ-উজ-জামান

হামিদ-উজ-জামান

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয় গরিবের কর্মসূচি

ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল দেশের গরিব মানুষের জন্য নেওয়া সরকারি কর্মসূচি। সেই সঙ্গে মিশে আছে গোড়ায় গলদ। ক্ষমতাসীন সুবিধাভোগীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে কর্মসূচির বাইরে থেকে যায় ৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ গরিব মানুষ। ফলে দরিদ্রতা নিরসন ও সামাজিক নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে পারছে না এসব কার্যক্রম। এমন অবস্থায় চলমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করেছে অর্থনৈতিকসংক্রান্ত টাস্কফোর্স। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এর খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ‘বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণসংক্রান্ত’-টাস্কফোর্সের সুপারিশে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো একত্রিত করতে বলা হয়।

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুধু বাজেট বাড়িয়ে দেখানোর জন্য বিগত আওয়ামী সরকারের সময় সামাজিক নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু অপ্রাসঙ্গিক কর্মসূচি যুক্ত করে বাস্তবায়ন দেখানো হয়। যেমন সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন, ভর্তুকি, জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা এমনকি অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচিও সামাজিক নিরাপত্তা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। যেসব কার্যক্রম সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে রং লাগিয়ে অতিরঞ্জিত করছে। এসব কর্মসূচি মোট সামাজিক নিরাপত্তা খাতের একটি বড় অংশ। যা প্রকৃত গরিব মানুষদের কাজে আসছে না। এটি রাজনৈতিক প্রচারণার একটি কৌশল হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, গরিব মানুষের জন্য সরকারি বিনিয়োগের প্রমাণ হিসাবে এসব কার্যক্রম দেখানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর গোড়াতেই রয়েছে গলদ। অর্থাৎ সুবিধাভোগী (প্রকৃত গরিব) বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছিল। সেই সঙ্গে ছিল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ফলে যারা এই সুবিধা পেয়েছেন বা এখনো পাচ্ছেন, তাদের প্রায় অর্ধেকই পাওয়ার যোগ্য নন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের ‘হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড অ্যাক্সপেনডিচার সার্ভে’র তথ্য ব্যবহার করে টাস্কফোর্স বলছে, দেশের ৫৩ দশমিক ৯ শতাংশ দরিদ্র মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বাইরে রয়েছেন। এ কারণে যে উদ্দেশ্যে সরকারি অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে তা পূরণের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে।

টাস্কফোর্স আরও বলেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলো একত্রীকরণ ও সমন্বয়ের প্রচেষ্টা ছিল না বললেই চলে। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৩৮টি থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১৫টিতে নামিয়ে আনা হয়েছিল। তবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেগুলো আবার ১৪০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। প্রায় ৩০টি সরকারি সংস্থা এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ করছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতা হিসাবে নগণ্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়লেও সেগুলোর বরাদ্দ সমন্বয় করা হয় না। ফলে এই অর্থ গরিবের জীবনে তেমন সুফল বয়ে আনে না। এসব সমস্যা সমাধানে দেশের প্রকৃত দরিদ্রতা নিরসনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে একটি শক্তিশালী ডাটাবেজ দরকার বলে মনে করে টাস্কফোর্স। এর মাধ্যমে প্রকৃত দরিদ্র বাছাইয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সেই সঙ্গে মানুষকে দরিদ্রতা থেকে বের করে আনতে সামাজিক বিমাভিত্তিক প্রকল্প বা কর্মসূচি থাকতে হবে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণে আর্থিক সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। শহরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির যে ফাঁক রয়েছে তা বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে জলবায়ু অভিযোজনকে গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন কার্যক্রমে এনজিওগুলোর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর করে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গরিব মানুষের জন্য নেওয়া কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে।

টাস্কফোর্স বলছে, সরকারি হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় মোট জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। যা জাতীয় বাজেটের ১৭ শতাংশ। তবে পেনশনসহ প্রায় ২১টির মতো অপ্রাসঙ্গিক কর্মসূচি বাদ দেওয়া হয় তাহলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারি ব্যয় নেমে আসবে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশে এবং জাতীয় বাজেটের ৭ শতাংশে।

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, যেসব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চলে আসছে সেগুলোতে নানা ফাঁকফোকর আছে। উপকারভোগী বাছাই থেকে শুরু করে তাদের হাতে সহায়তা পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। এখন সময় এসেছে এসব বন্ধ করার। এক্ষেত্রে প্রকৃত গরিব মনুষদের চাহিদা, প্রয়োজন, বাস্তবতা এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে নতুনভাবে কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মসূচির মধ্যে বৈচিত্র্য আনা দরকার। এসি রুমে বসে পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ হবে না। মাঠে গিয়ে প্রকৃত অবস্থার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। চলমান কর্মসূচির মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে না প্রকৃত গরিবরা, না ধনীরা কেউই উপকার পায়নি। মাঝপথে একটি মহল সুবিধা লুট করেছে। রাজনৈতিক হোক আর যে কারণেই হোক এত লিকেজ ছিল, যা বন্ধ করা যায়নি।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এক সেমিনারে অংশ নিয়ে কথা বলেন সমাজকল্যাণ এবং নারী ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন মোর্শেদ। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষার নামে সামান্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে দেশ থেকে অতি দরিদ্রতা ঘোচানো সম্ভব নয়। এজন্য নগদ সহায়তানির্ভর সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলোকে কর্মমুখী সহযোগিতায় রূপান্তর করতে হবে। তিনি বলেন, টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে উপকারভোগী বাছাইয়ে ৪০-৫০ শতাংশই ভুয়া। এক্ষেত্রে যদি ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয় তাহলে এর ৫০০ কোটিই অপচয় হওয়ার ঘটনা ঘটে। আমরা এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে ভেতরে ভেতরে কাজ করছি। দারিদ্র্য ঘোচাতে সবার আগে একটি নির্ভুল তথ্যভান্ডার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির কারণে অতীতে সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দ স্বচ্ছতা বজায় রাখা যায়নি। এসব দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ ও জবাবদিহি নিশ্চিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি ডিজিটাল ড্যাসবোর্ড তৈরি করে দিতে বিশ্বব্যাংকের কাছে অনুরোধ করেছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম