Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

বাস্তবায়ন নয়, দেখা হতো আ.লীগের লাভালাভ

দুই প্রকল্পেই অপচয় ৫৫০ কোটি টাকা

মাঝপথে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে হচ্ছে না বিদ্যুৎকেন্দ্র

Icon

হামিদ-উজ-জামান

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে উন্নয়নের নামে হাতে নেওয়া প্রকল্প যেন ছিল ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁস’। একবার শুধু নিতে পারলেই হতো। বছরের পর বছর মিলত নানা সুযোগ-সুবিধা। আসল লক্ষ্য অর্জন হবে কিনা সে বিষয়ে ছিল না কোনো নজর। এমনই দুটি প্রকল্প হচ্ছে ‘ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব গজারিয়া ৩৫০ মেগাওয়াট কোল ফায়ারড থারমাল পাওয়ার প্ল্যান্ট’ এবং ‘শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ’। এ দুটি প্রকল্পে অপচয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫শ কোটি টাকা। কেননা একটির আওতায় ২৫২ একর জমি অধিগ্রহণ করার পর মাঝপথে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বিদ্যুৎ প্রকল্প আর হবে না। এখন এই জমি সংরক্ষণসহ নানা কাজ করতে গিয়ে বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে। এ যেন গলার ফাঁসে পরিণত হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের। অপরদিকে অন্য একটি প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন আবাসিক ভবন তৈরি ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনা হলেও দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হয়নি। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) শেষ হয়ে যাওয়া প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করতে গিয়ে এমন চিত্র পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, এক্ষেত্রে শুধু অর্থের অপচয়ই নয়, সময় ও শ্রমেরও অপচয় হয়েছে। কেননা, ওই সময় দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা না করে হুটহাট করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পগুলোর ঠিকমতো সম্ভাব্যতা সমীক্ষাই করা হতো না। বিশ্বের অনেক দেশ যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছিল সে সময় আমরা এ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। এগুলো অপরিকল্পিত প্রকল্প। তবে যাই হোক, জমি যেহেতু নেওয়া হয়েছে, সেটি অন্য কোনো উৎপাদনশীল কাজে লাগানো উচিত। তিনি আরও বলেন, অতীতে আমাদের দেশে প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। ফলে তারই নেতিবাচক প্রভাব এসব প্রকল্পে পড়েছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই প্রকল্প নিচ্ছে।

আইএমইডি জানায়, অপরিকল্পিত প্রকল্প নেওয়ার খেসারত হিসাবে অপচয় হয়েছে জনগণের বিপুল অঙ্কের টাকা। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় কয়লাভিত্তিক ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলেও সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর হচ্ছে না। উপরন্তু অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা ২৫২ একর জমি যেন বাড়তি খরচের খাতে পরিণত হয়েছে।

আইএমইডি জানায়, ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড গজারিয়ার প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। ২০১৬ সালের ১৪ জুন অনুষ্ঠিত একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) সভায় এটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুযায়ী মোট প্রকল্প ব্যয় হচ্ছে ৫০৪ কোটি ২৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। প্রাথমিক অবস্থায় প্রকল্পের কাজ শুরুর তারিখ ছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই এবং সমাপ্তির তারিখ ছিল ২০১৮ সালের ৩০ জুন। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণে স্থানীয় জনগণের বাধা ও স্থানীয় বিভিন্ন সমস্যার কারণে ভূমি অধিগ্রহণ দেরি হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৯ মে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ভূমি হস্তান্তর করা হয়। পরে সরেজমিন কাজ শুরু করতে গেলেও প্রথম দিকে স্থানীয়দের বাধার কারণে কাজ শুরু করা যায়নি। ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে সরেজমিন কাজ শুরু করা হয়। অর্থাৎ অনুমোদিত মূল মেয়াদের মধ্যে কোনো কাজই শুরু করা যায়নি। এজন্য প্রকল্পটির মেয়াদ ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া ১ বছর বাড়ানো হয়। ডিপিপি সংশোধন করে মেয়াদ ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল ৩৫০ মেগাওয়াট কোল ফায়ারড থারমাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা। সেজন্যই ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় সীমানা প্রাচীর নির্মাণ হয়নি। মূল কাজ শুরু না হওয়ায় অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন করা ২৫২ দশমিক ৫৬ একর ভূমি বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন করা ভূমি রক্ষার স্বার্থে জরুরিভিত্তিতে ভূমির চারদিকে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ প্রয়োজন। পাশাপাশি দেখভাল করার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিকিউরিটি গার্ড, কেয়ারটেকার বা আনসার নিয়োগ করা দরকার।

এদিকে অপর এক প্রকল্পের আওতায় পড়ে আছে আবাসিক ভবন ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে এগুলো। খুলনার ‘শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ’ প্রকল্পে বিরাজ করছে এমন অবস্থা। এগুলো কেন পড়ে আছে এবং এর পেছনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল আইএমইডি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। ফলে নির্ধারিত সময় থেকে প্রায় ৫ বছর বেড়ে যায় মেয়াদ এবং বাড়ে ব্যয়ও। আইএমইডি বলেছে, প্রকল্পের আওতায় সৃষ্ট আবাসিক ইউনিটগুলোর মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশই (পরিচালক) এবং উপ-পরিচালকের বাংলোসহ ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর (হস্তান্তরের তারিখ) থেকে অব্যবহৃত রয়েছে। ফলে উদ্দেশ্য অর্জন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী অযত্নে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিষয়টি উদ্যোগী মন্ত্রণালয় (স্বাস্থ্য) যথাযথ তদন্ত করতে পারে। এছাড়া জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘শহিদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল সম্প্রসারণ, খুলনা’ প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ৫৭ কোটি ৯২ লাখ ১৮ হাজার টাকা। পরে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৬২ কোটি ১৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। এছাড়া অনুমোদিত মেয়াদ ছিল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ২ বছর। কিন্তু পরে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময় চলে যায় প্রায় সাড়ে ৭ বছর। আইএমইডি বলেছে, প্রকল্পটির ডিপিপিতে উদ্দেশ্যগুলো সুনির্দিষ্ট নয় এবং কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভবিষ্যতে এ রকম প্রকল্প দলিল তৈরির ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য নির্ধারণে আরও যত্নবান হতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম