জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা
ধরাছোঁয়ার বাইরে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা
অধিকাংশ কর্মকর্তা পেয়েছেন প্রাইজ পোস্টিং
![ধরাছোঁয়ার বাইরে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/09/5888-67a80d7374f13.jpg)
জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা। ছাত্রদের প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচিতে অংশও নেন তারা। ধারণা করা হচ্ছিল, ৫ আগস্টের পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় তারা এখন গোপনে, এমনকি প্রকাশ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ তালিকায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে পরিচালক, সহকারী পরিচালক, পরিদর্শকসহ অন্তত ৩০ জনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে তাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।
পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি দলীয়করণ করা হয়। এতে শিক্ষার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও অধিদপ্তরগুলোয় দলীয় মতাদর্শের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। বিশেষ করে শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) আর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে পরিদর্শক পর্যন্ত প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর ফলে মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তারা পড়ে যান পেছনে। এখনো তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। অথচ পুরোনো দলবাজ সেই কর্মকর্তাদের একটা বিরাট অংশ শিক্ষা বিভাগ দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ উপযুক্ত জায়গায় হচ্ছেন পদায়ন। সম্প্রতি মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) পদে দুর্নীতিবাজ এক শিক্ষকের নিয়োগ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। এছাড়া জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) মহাপরিচালক (ডিজি) পদেও বিতর্কিত এক কর্মকর্তার নিয়োগ নিয়ে চলছে সমালোচনা।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার পতনের একদিন আগে ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন শিক্ষা ক্যাডারের অন্তত ৩০ জন কর্মকর্তা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রবেশপথে বিক্ষোভ করেন ওই সরকারের সুবিধাভোগী ও লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হওয়া শিক্ষা ক্যাডারের এই কর্মকর্তারা। ওই মিছিলের নেতৃত্বে এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে লিফলেট বিতরণ করেন ৩১ ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা মুকিব মিয়া। মঙ্গলবার তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়।
শিক্ষা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের পক্ষে স্লোগানধারী কর্মকর্তারা অন্তর্বর্তী সরকারের পতনসহ নানা যড়যন্ত্র করছেন। তাদের কেউ কেউ বদলি হলেও কেউ কর্মস্থলে যোগদান না করে ঢাকায় বসে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে। মঙ্গলবার শেখ হাসিনার পক্ষে মুকিব মিয়ার লিফলেট বিতরণ এবং তাকে আটকে নড়েচড়ে বসেছে শিক্ষা প্রশাসন।
জানা যায়, ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে স্লোগানের সামনে না থাকলেও এর নেপথ্যে ছিলেন মাউশির তৎকালীন ডিজি নেহাল আহমেদ। অর্থায়ন করেন মাধ্যমিক শাখার সাবেক পরিচালক সৈয়দ জাফর আলী, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের বর্তমান পরিচালক একিউএম শফিউল আজম এবং ওই সময়ের উপপরিচালক (প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা পরিদর্শক স্বরূপ কুমার কাহালিও মিছিলে স্লোগান দেন এবং অন্যরা তার সঙ্গে সুর মেলান। এ সময় তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন-পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা পরিদর্শক ড. আবুল কালাম আজাদ, মো. মুকিব মিয়া (ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক), মোহাম্মদ মনকিউল হাসানাত, মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, মো. আলমগীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম, মো. রিপন মিয়া, সরকার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ দিদার, সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক সাদিয়া সুলতানা, আশরাফুর রহমান খান, কামরুন নাহার, মোহাম্মদ ওয়ায়েছ আলকারনী মুন্সী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার শিক্ষা অফিসার মিজানুর রহমান, মো. তরিকুল ইসলাম, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার গবেষণা কর্মকর্তা রিয়াদ আরাফাত, সুমন বিশ্বাস, প্রশিক্ষণ শাখার গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজন। এছাড়া ৪ আগস্ট স্লোগানের সব পরিকল্পনা করা হয় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্মপরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের দপ্তরে। ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়মিত আড্ডার স্থল তার দপ্তর। তিনি পতিত সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে টানা ১৩ বছর চাকরি করেছেন। তিনি সেখানে একক আধিপত্য বিস্তার করতেন। ৫ আগস্টের পর তাকে টাঙ্গাইল বদিল করা হয়। পরিদর্শনের নামে শত শত কোটি টাকার ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ তালিকার জাফর আলী ছাত্রলীগ করা কর্মকর্তাদের নিয়ে কয়েক বছর আগে স্বাধীনতা বিসিএস শিক্ষা সমিতির নামে একটি সংগঠন বানান। সেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের আস্থাভাজন সৈয়দ জাফর আলীকে ঢাকার সবচেয়ে কাছের জেলা মানিকগঞ্জে বদলি করা হয়েছে। আর বিপুল চন্দ্র সরকারকে রাজবাড়ী সরকারি কলেজে। সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী যারা চাকরিতেই বহাল থাকার কথা নয়, তাদের করা হচ্ছে ঢাকার আশপাশের জেলায় বদলি। এ নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে তৈরি হয়েছে নতুন অস্থিরতা।
সূত্র জানায়, ৪ আগস্টের মিছিলে অংশ নিয়েও মাউশিতে এখনো বহাল তবিয়তে আছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখার গবেষণা কর্মকর্তা মো. ইউসুফ রহমান ও মোহাম্মদ আবুল হোসেন কায়েস, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) শিক্ষা পরিদর্শক কামরুন নাহার। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল শিক্ষা পরিদর্শক কামরুন নাহারের। সেই সুযোগে তিনি মাউশির পরিকল্পনা শাখায় পদায়ন পান। পরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির হাত ধরে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে আসেন তিনি। ৪ আগস্টের মিছিলে সামনের দিকে ছিলেন কামরুন নাহার। সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী সাদিয়া সুলতানাকে গত সপ্তাহে বদলি করা হলেও একই দপ্তরে বহাল আছেন সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক ও ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্মসম্পাদক আসমা আক্তার, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোহানের স্ত্রী মনির মুর্শেদ এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী শেখ কামরুন্নাহার ও মোহাম্মাদ মনিরুল ইসলাম।
৪ আগস্ট মিছিলের স্লোগান দেওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সরকার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ দিদারকে ঢাকার কাছে শরীয়তপুর সরকারি কলেজ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দেলওয়ার হোসেন প্রাইজ পোস্টিং পান নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে। ঢাকার পাশে বদলি করা হয়েছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শক সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের ক্যাশিয়ার ওয়ায়েস আলকার্ণি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মাউশির কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বাবু, রিয়াদ আরাফাত, হাফিজুর রহমান সিকদার ঢাকা বিভাগে বিভিন্ন জেলায় বদলি হয়ে বহাল আছেন এখনো।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের স্ত্রীর ক্যাশিয়ার ছিলেন মন্ত্রণালয়ের লেইস প্রকল্পের সাবেক উপপরিচালক বিজয় ঘোষ। তাকে মেহেরপুর সরকারি কলেজে বদলি করা হয়।
পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. একিউএম শফিউল আজম দীপু মনির ঘনিষ্ঠ হিসাবে বেশ প্রভাব খাটান শিক্ষা বিভাগে। দীপু মনির সঙ্গে সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণও করেন তিনি। দীপু মনির মন্ত্রণালয় পরিবর্তনের পর মিশে যান নওফেলের সঙ্গে। বদলি আতঙ্কে থাকা ওই কর্মকর্তাকে সম্প্রতি মহাপরিচালকের অতিরিক্ত (এডিজি) দায়িত্বে দেওয়া হয়। এছাড়া মাউশির অর্থ ও ক্রয় উইংয়ের সহকারী পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদকে সম্প্রতি গাজীপুরে মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমিতে বদলি করা হয়। এটি তার জন্য প্রাইজ পোস্টিং বলে মনে করছেন অনেকে।
আওয়ামী লীগের পক্ষে মিছিলে অংশ নেওয়া সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক কামরুন্নাহার যুগান্তরকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে আমি সততার সঙ্গে কাজ করি। সেটাই দেখার বিষয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়। এখনো বহাল তবিয়তে আছেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটি প্রতিষ্ঠানপ্রধান ভালো জানেন।
নতুন নিয়োগ পাওয়া মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ড. এহতেসাম উল হকের প্রত্যাহারের দাবিতে বৃহস্পতিবার মাউশি ভবন ঘেরাও করেছে শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট। দ্রুত সরানো না হলে আরও কঠোর কর্মসূচির দেওয়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
মাউশির ডিজি অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এহতেশামুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, সেগুলো একধরনের ষড়যন্ত্র। আমার কাছ থেকে যারা সুবিধা নিতে পারেননি, তারা এ ধরনের অভিযোগ করছেন। চাকরিজীবনে সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা আমি ভোগ করিনি।