Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

৮০ ভাগ মেশিন অকার্যকর

দুর্দশায় শ্রমিকশূন্য ২৫ জুট মিল

জলে যাচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ * পাকিস্তান আমলে স্থাপনের পর আর পরিবর্তন হয়নি * অকেজো মেশিনারিজ বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে * সব মিল বন্ধের তথ্য সঠিক নয় : পাট সচিব

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৫৪ সালে পুরাতন মেশিনপত্রের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় জুটমিল স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে এসব জুট মিল নেওয়া হয়। অন্তত ৭৮টি মিল বুঝে পায় বিজেএমসি। বাংলাদেশে সোনালি দিনের সূচনা হয় এসব জুট মিলের মাধ্যমে। দিন-রাত কাজ চলত এসব মিলে। শ্রমিকদের মুখে ছিল হাসি। শুরুর দিকে মিলগুলো বেশ লাভজনকও ছিল। কিন্তু দিন যতই গড়াতে থাকে, ততই অবহেলা আর অবজ্ঞা বাড়তে থাকে তদানীন্তন সরকারগুলোর। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকার আর্থিক ক্ষতি দেখিয়ে ২০২০ সালের জুলাইয়ে সব মিল একসঙ্গে বন্ধ করে দেয়। রাস্তায় নামেন শ্রমিকরা। বড় ধরনের আন্দোলন হলেও তাদের ভাগ্য আর খোলেনি। সেই সঙ্গে কপাল পুড়েছে অন্তত ২৫টি মিলেরও। ঢাকার ৭টি, খুলনায় ৯টি, চট্টগ্রামে ৯টি-এই ২৫টি মিল এখন প্রায় শ্রমিকশূন্য। মিলের সংস্কারসহ শ্রমিকদের দুর্দশা লাঘবে নেই কোনো উদ্যোগ। মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে ২৫টি মিলের প্রায় সব মেশিনারিজ। এতে জলে যাচ্ছে সরকারের প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে অন্তত ৪০০ একর গুরুত্বপূর্ণ জমি। পুনরায় এসব মিল চালু করতে প্রয়োজন বিপুল অর্থ। আর্থিক বিষয় সামনে থাকায় এখন পর্যন্ত মিলগুলোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

এদিকে, মেশিনগুলো নষ্ট দেখিয়ে লোহা হিসাবে বিক্রি শুরু হয়েছে। এতে লাভবান হচ্ছেন মিলের শীর্ষ কর্তারা। উৎপাদন না থাকায় মিলের অভ্যন্তরে তৈরি করা হয়েছে গরুর খামার। ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব খামারে ব্যবহার করা হচ্ছে মিল শ্রমিকদের।

তথ্যমতে, বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) নিয়ন্ত্রণাধীন জুট মিলের সংখ্যা ২৫টি। এসব মিলের মেশিনের সংখ্যা রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। এরমধ্যে ব্রেকার ফিনিশার কার্ড ৮১৭টি, ড্রইং ফ্রেম ১ হাজার ১৭৭টি, স্পিলিং ফ্রেম ২ হাজার ০২৯টি, তাঁত ১১ হাজার ১৫৮টি, ওয়ার্কশপ ২ হাজার ৯৮৮টি এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ রয়েছে ১ হাজার ১৫৪টি। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫০০ কোটি টাকার বেশি। ইতোমধ্যেই নষ্ট দেখিয়ে বেশকিছু মেশিন স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাকিগুলো বিক্রির প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর ডেমরায় অবস্থিত করিম জুট মিল। তালাবদ্ধ মিলের অধিকাংশ গেট। বন্ধ উৎপাদন কার্যক্রম। শ্রমিক না থাকায় ভেতরে সুনসান নীরবতা। সারি সারি মেশিনে জমে আছে ধুলাবালি ও ময়লা। মরচে ধরছে সব যন্ত্রপাতিতে। দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদনে না গেলে এসব মেশিন কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। বাধ্য হয়ে স্ক্র্যাপ করে বিক্রি ছাড়া উপায় থাকবে না সরকারের।

সরেজমিন দেখা যায়, করিম জুট মিলে উৎপাদন না থাকায় ভেতরে গরুর খামার তৈরি করছেন প্রকল্প প্রধান মুহাম্মদ হুমায়ুন খালিদ। এতে ছোট-বড় প্রায় ১৬টির মতো গরু রয়েছে। খামার রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছে মিল শ্রমিকদের। এ বিষয়ে হুমায়ুন খালিদ যুগান্তরকে বলেন, খামারটি আগের পরিচালকের। তিনি দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়ার সময় আমি ক্রয় করেছি। এটা নিয়ে লেখালেখি হলে আমি সমস্যায় পড়ব।

একই চিত্র দেখা গেছে ডেমরায় অবস্থিত লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে। সেখানেও উৎপাদন বন্ধ থাকায় সব মেশিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হারাচ্ছে উৎপাদন ক্ষমতা। মিলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা একজন যুগান্তরকে বলেন, সব দামি মেশিন। কিন্তু এখানে সরকারের নজর নেই। চালু করার পরিকল্পনাও নেই। এমন ভাবে চললে সব স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করতে হবে। তার ভাষ্যমতে, মিলের দায়িত্বশীলরা চান না মিলগুলো চালু করতে। তারা চান মেশিনগুলো দ্রুত নষ্ট হোক। মূলত নষ্ট মেশিন স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করলে তারা লাভবান হন।

লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প প্রধান মো. মুহিউদ্দিন ছাদেক যুগান্তরকে বলেন, মেশিনগুলো চালু করা জরুরি। আশা করি সরকার এই বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

উৎপাদন বন্ধ থাকায় মূল্যবান যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে হাফিজ জুট মিলেও। রাতের অন্ধকারে চুরি হয়ে যাচ্ছে মালামাল। নিজ উদ্যোগে মিলের অভ্যন্তরে গরু-ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগির খামার তৈরির অভিযোগ রয়েছে প্রকল্প প্রধান জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। ব্যক্তি মালিকানায় তৈরি এই খামারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে মিলের শ্রমিকদের। তবে এমন অভিযোগ মানতে নারাজ প্রকল্প প্রধান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এসব অভিযোগের সত্যতা নেই। এগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হাফিজ জুট মিলের সিবিএর সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, মিলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে মিল চালু করতে সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে অনুরোধ করেন তিনি।

নষ্ট দেখিয়ে ইতোমধ্যেই লোহা হিসাবে ১ হাজার টন মেশিন বিক্রি করা হয়েছে নরসিংদীর ইউএমসি জুট মিলে। আরও প্রায় ১ হাজার তিনশ মেশিনারিজ বিক্রির জন্য টেন্ডার করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে এসব মেশিন বিক্রিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে মিলের প্রকল্প প্রধান মতিউর রহমান মণ্ডলের বিরুদ্ধে। তবে অভিযোগ মানতে নারাজ তিনি। যুগান্তরকে বলেন, সরকারের বিক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী বিক্রি করা হচ্ছে। জাতীয় পত্রিকায় টেন্ডার প্রকাশ, বিজেএমসি ও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই বিক্রি করা হচ্ছে।

শুধু করিম জুট মিল ও লতিফ বাওয়ানী জুট মিলই নয়-ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহীসহ সারা দেশে বিজেএমসির আওতাধীন ২৫টি জুট মিলে একই চিত্র। উৎপাদন না থাকায় নষ্ট হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালে ৭৮টি মিল নিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই সময় বিজেএমসির লক্ষ্য ছিল উন্নতমানের পাটজাত পণ্য উৎপাদন, পাটজাত পণ্যের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে নিয়ন্ত্রণ, শতভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষকদের পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। তবে ২০২০ সালের জুলাইয়ে আর্থিক ক্ষতি ও শ্রমিক অসন্তোষ দেখিয়ে বিজেএমসির ২৫টি মিলের উৎপাদন একযোগে বন্ধ করে সরকার। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে পাট সচিব আবদুর রউফ বলেন, সব মিল বন্ধের তথ্য সঠিক নয়। কিছু মিল চালু রয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম