পুরান ঢাকার আতঙ্ক কিশোর গ্যাং ‘লাম’

পুরান ঢাকায় কিশোর গ্যাং ‘লাম’সহ অন্তত আটটি বাহিনীর চাঁদাবাজি, দখল, মাদক কারবার, ছিনতাই ও টার্গেট কিলিংয়ে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকারের পতনের পর পুলিশি নজরদারি দুর্বল হয়ে পড়ায় এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, পর্দার আড়াল থেকে এসব গ্যাংকে আশ্রয় দিচ্ছে সম্প্রতি জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসা পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কয়েকজন। সূত্রাপুর, লালবাগ, বংশাল, চকবাজার, কোতোয়ালি, ওয়ারী ও কামরাঙ্গীরচরে গেল দুই বছরে গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে ১৫টির বেশি কিশোর নিহত হয়েছে। এসব ঘটনায় কয়েকজন কারাগার ও কিশোর সংশোধনাগারে থাকলেও অন্য সদস্যরা জামিনে এসে পুরনো রূপে ফিরে এসেছে।
জানা যায়, সূত্রাপুরের ধোলাইখাল এলাকায় সাধারণ ব্যবসায়ীদের ‘ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি’ দিয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সূত্রাপুর থানার অন্তর্গত ধোলাইখাল এলাকার ৬৫/১ নাসির উদ্দিন সরদার লেনের হাজী মনসুর মার্কেটের মৃত হাজী ইব্রাহীমের ছেলে মো. মিজান ও ১নং গোয়ালঘাট লেনের হাজী ভোলা মিয়ার ছেলে মো. আতিকুর রহমান জুয়েল গোয়াল ঘাটের সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের দিয়ে চাঁদা আদায় করছেন।
ব্যবসায়ী সোয়েব কামাল জানান, মিজানের ছেলে ইসমাইল লাম (১৯) সশস্ত্র কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে। কোনো ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বা চাঁদা প্রদানে বিলম্ব করলে মিজান ও জুয়েল সশস্ত্র কিশোর গ্যাংয়ের লিডার ইসমাইল লাম ও তার গ্যাংকে পাঠিয়ে ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে চাঁদা দিতে বাধ্য করে। ব্যবসা ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সাধারণ ব্যবসায়ীরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ সাহস করে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেও মিলছে না প্রতিকার।
‘লাম’ বাহিনীর অত্যাচারে এই এলাকার বিভিন্ন ভবনের মালিক গেটে একাধিকবার তালা দিলেও সেটি ভেঙে ছাদে উঠে তারা। সারারাত সেখানে মাদক সেবনসহ চিৎকার-চেঁচামেচি করে সকালে বের হয়। তাদের বিপক্ষে কথা বললে উল্টো বিপদ আরও বাড়ে বলে জানান কালাম নামের এক বাড়িওয়ালা। তিনি বলেন, ‘আমি চাকরি করি। কিছু বলতে পারি না, কারণ আমার ঘরে একটি মেয়ে রয়েছে। ওরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকে। পুলিশের কথা বললে তারা বলে, আমাদের বের হতে কয়েক মিনিটের ব্যাপার।
এ এলাকা ছাড়াও পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, কলতাবাজার, পানিটোলা, লালকুঠি, শ্যামবাজার, ইসলামপুর, বাবুবাজারসহ সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফেরদৌস গ্রুপ, সাজু গ্রুপ, সিনিয়র গ্রুপ, জুনিয়র গ্রুপ, টাইগার গ্রুপ, চিতা গ্রুপ, বড় বাপের পোলাসহ বহু কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে। প্রতিটি গ্যাংয়ে ৫০ থেকে ৬০ জনের বেশি কিশোর রয়েছে। এদের কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে। কেউ এখনো পড়ছে। কেউ মাদকের মামলার আসামি। সন্ধ্যা হলেই পুরান ঢাকার গলিগুলো ভীতিকর অবস্থায় পরিণত হয়। গলিতে গলিতে জড়ো হয়ে চালায় বেপরোয়া মোটরসাইকেল। কেউ করে ছিনতাই। পথচারী নারীরা হারান সম্মান। হাতিয়ার হিসাবে তারা ব্যবহার করে পিস্তল, ছুরি, চায়নিজ চাকু ও ব্লেড। বীরত্ব দেখাতে তুচ্ছ ঘটনায় প্রকাশ্যে রাস্তায় খুনাখুনি করতেও তাদের হাত কাঁপে না।
এলাকাবাসী বলছে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গত তিন মাসে সূত্রাপুর, চকবাজার, লালবাগ, সদরঘাট থানা এলাকায় ব্যাপকভাবে নীরব চাঁদাবাজি চলছে। সন্ধ্যা নামলেই সূত্রাপুরের ধোলাইখাল ছিনতাই চুরি ডাকাতির স্পটে পরিণত হয়। বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে চলে লাম বাহিনীর তাণ্ডব। এই সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাদক কারবারিরাও ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এলাকার বিভিন্ন মার্কেট, ফুটপাত দখল নিয়ে সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি, সংঘাত ও হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। তবে অধিকাংশ ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি কিংবা মামলা নেয়নি পুলিশ। এতে ধোলাইখালের সাধারণ ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতা রাহাত বলেন, এলাকায় একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দাপটে সাধারণ মানুষ ভীত ছিল। তারা এখন পলাতক। তবে তাদেরই ছত্রছায়ায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজি, দখল, মাদক কারবার, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিগত বছরগুলোয় গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীরা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় যাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে স্থানীয় নেতাদের। কোনো নেতাকর্মী চাঁদাবাজি বা কিশোর গ্যাংকে সেল্টার দিলে তার বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিশোর গ্যাং কালচার ও পুলিশের বক্তব্য : স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই কিশোরদের একটি অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে তারা। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাস্তানি করে। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে হঠাৎ করে অপরাধ বেড়েছে। পুলিশের মূল্যায়ন হচ্ছে, এর মূলে রয়েছে কিশোর-তরুণ গ্যাং। হত্যা, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে এসব অপরাধী সুযোগ পেলে নারীদেরও উত্ত্যক্ত করছে।
ডিএমপির লালবাগ বিভাগের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, লালবাগ জোনের ৬ থানাকেন্দ্রিক অপরাধীদের তালিকা পুলিশের কাছে রয়েছে। এসব অপরাধীকে গ্রেফতার ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সূত্রাপুর এলাকার বিভিন্ন ঘটনা এবং সেখানে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সম্পর্কে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বেশির ভাগ ঘটনাতেই মামলা হয়েছে এবং আসামিদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে।